অতীত ভুলে ভারতের সঙ্গে ‘নতুন সম্পর্ক’ চায় বিএনপি

আশি এবং ৯০ দশকের রাজনীতি অতীত হয়ে গেছে ‘নতুন সম্পর্কের’ বার্তা নিয়ে বিএনপির তিন নেতার ভারত যাওয়ার খবর প্রকাশ করেছে দেশটির গণমাধ্যম।

ভারতের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশে সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দলটির প্রতিনিধিরা ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রতিবেশী দেশটির সহায়তাও চেয়ে এসেছে।

দেশটির প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দু এই খবর প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়ার মিন্টু এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক হুমায়ুন কবির এখন ভারত অবস্থান করছেন।

দ্য হিন্দু জানাচ্ছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে বিএনপি ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক তৈরির মিশনে রয়েছে।

বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ভারত সফর করলে সেটা ঘটা করে জানিয়ে করা হয়। কিন্তু বিএনপির প্রতিনিধি দল পাঠানোর বিষয়টি গণমাধ্যমে আসেনি, বিএনপির নেতারাও এই বিষয়ে কিছুই বলেননি।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন এবং সম্মানসূচক ডি লিড ডিগ্রি গ্রহণে পশ্চিমবঙ্গ সফর নিয়ে বিএনপির নেতারা টিপ্পনি কেটেছেন। তারা বলেছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে এই সফর।

অথচ প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে ফেরার দুই সপ্তাহের মধ্যেই সে দেশটিতে অনেকটাই গোপনে গেলেন বিএনপির তিন নেতা।

ভারতীয় মর্যাদাশীল গণমাধ্যম দ্য হিন্দু জানিয়েছে, এই সফরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ-অনুযোগ জানিয়ে এসেছেন বিএনপি নেতারা। বলেছেন, তারা ভারতের সঙ্গে ‘নতুন’ সম্পর্কে আগ্রহী। তবে এই ‘নতুন’ সম্পর্ক বলতে কী বুঝায় সেটি দ্য হিন্দু প্রকাশ করেনি।

বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে যা বলে থাকেন, তার অর্থ এই দেশের ক্ষমতায় কে আসবে, সেটিতে ভারতের পছন্দ গুরুত্বপূর্ণ। এর যৌক্তিক কী কারণ, সেটি অবশ্য জানাননি তারা।

আবার ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যেকোনো বিষয়ে বিএনপি বরাবর সন্দিহান। এমনকি ৯০ দশকের শেষ দিকে ঢাকা-কলকাতা রুটে বাস চালুর পর সার্বভৌমত্ব চলে যাবে অভিযোগ করে ৭২ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছিল দলটি।

আবার ২০১৩ সালের মার্চে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার সঙ্গে সাক্ষাৎ বাতিল করেন জামায়াতের হরতালে নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে। এই বিষয়টিও ভারত ভালোভাবে নেয়নি বলে গণমাধ্যমে এসেছে।

আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সই হওয়ায় ফেনী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে আশঙ্কা প্রকাশ করে লং মার্চ করেছিল বিএনপি।

আবার ভারত মনে করে, বিএনপি সরকারের আমলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর আস্তানা তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে। যারা এখান থেকে গিয়ে ভারতে নানা আক্রমণ চালিয়েছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী বহু নেতাকে শেখ হাসিনা সরকার ভারত সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে-এটি প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

তবে বিএনপির প্রতিনিধি দলের সদস্য ও তারেক রহমানের উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির ‘দ্য হিন্দু’কে বলেন, ‘আমরা পেছনের সব ভুলে সামনে এগোতে চাই। আর আশি নব্বই দশকের রাজনীতি এখন অতীত।’

এর আগে ২০১২ সালে খালেদা জিয়ার ভারত সফরের সময় তিনি বলে এসেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ‘ভারত বিরোধী কার্যকলাপের জন্য কখনো ব্যবহার করা হবে না।’

দ্য হিন্দু বলছে, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন (১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬) সময়ে জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান হয়। এসব জঙ্গি গোষ্ঠি ভারতকে টার্গেট করে। সেসব জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম হরকাতুল জিহাদ। অন্যদিকে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব জঙ্গি গোষ্ঠিকে নির্মূল করেছেন। এবং ভারতের অনেক সন্ত্রাসীকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছেন।

হুমায়ুন কবির ‘দ্য হিন্দু’কে বলেন, তারেক রহমান চান উভয় দেশের তরুণ জনসংখ্যাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে। বিএনপির আগের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে সময়ে ভারত-বাংলাদেশের ‘খারাপ সম্পর্ক’ রাজনীতিকে বিপথে পরিচালনার জন্য হয়েছে।

নির্বাচনের জন্য সহযোগিতা কামনা

বিএনপি মনে করে বাংলাদেশে নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারত প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ২০১৩ সালে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংস আন্দোলনের সময় পশ্চিমা বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের পক্ষে ছিল। কিন্তু সরকার সংবিধানের বাইরে গিয়ে ভোট করতে রাজি ছিল না।

আর সে সময় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার বিষয়ে অবস্থানে ভারত এবং রাশিয়াকে পাশে পেয়েছিল বাংলাদেশ। বিএনপি মনে করে ভারতের অবস্থানের কারণেই আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারছে।

বিএনপির নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ হবে না, এবারও জানিয়ে গিয়েছে সরকার। আর দুই বার আন্দোলনে নেমে খালি হাতে ফেরা বিএনপি দৃশ্যত শক্তি ক্ষয় হওয়া আর একই ধরনের কর্মসূচি দিতে পারছে না। এই অবস্থায় দলটি ভারতের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে বলে জানিয়েছে দ্য হিন্দু।

শেখ হাসিনা একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান বলে দেশটির নেতৃস্থানীয়দের কছে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। দুনীতির মামলায় কারাদণ্ড পাওয়া চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি সরকারের সহযোগিতাও চেয়েছেন তারা।

দ্য হিন্দুকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের বড় প্রতিবেশীকে গঠনমূলক ভূমিকায় দেখতে চায়।’

‘বাংলাদেশে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, ভারত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সকল কাজকে সমর্থন করে। যদি বাংলাদেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়, তাহলে যে কেউ জয়ী হবে। এটি ভারতের জন্যও একটি জয়।’

দ্য হিন্দু বলেছে, ঐতিহাসিক কারণেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুসম্পর্ক ভারতের। কারণ, ১৯৭১ সালের মু্ক্তিযুদ্ধে শেখ হাসিনার পিতা এবং জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন করেছিলো ভার। পরে ১৯৭৭-১৯৮১ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে ইসলামপন্থী পথে পরিচালিত করেছিলেন। যা অনেকটা পাকিস্তানি সামরিক শাসনের মতো ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করে। সে সময় থেকেই তারা ক্ষমতা হারানোর ফলে সংগ্রাম করছে। এরই মধ্যে হাসিনা সরকার বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৭৮ হাজার মামলা করেছে। সেকথা তুলে ধরে সেসময়ে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলেছিলেন, এসব মামলায় প্রায় ১৮ লাখ নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তবে ২০১৬ সালে দ্য হিন্দুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি জানান, এ মামলাগুলো কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, এগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও দুর্নীতির জন্য করা হয়েছে।

দ্য হিন্দুকে খসরু বলেন, বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে এবং গণতন্ত্র অনুপস্থিত থাকলে অনেকগুলো গোষ্ঠী তৈরি হবে, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে।

‘বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচনের ক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হলো ভারতকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেয়া এবং পর্যবেক্ষণ করা।’