অসুস্থ সমাজ অসুস্থ নগরে আমরা একদল… || শারমিন শামস্

খুব দুঃখজনক, তবু সত্যকে এড়ানোর উপায় নাই। কবে কখন কোন ফাঁকে একটি অসুস্থ বিকৃত বিবেকহীন প্রজন্ম গড়ে উঠেছে আমাদের সমাজে। যারা কাউকে ছাড়ে না। নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ কেউ তাদের হাত থেকে নিস্তার পায় না।

পথেঘাটে দোকানে বাজারে অফিসে আদালতে তো বটেই, এরা ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনেও। মূলত এদের দাঁতাল চেহারাটি আরো স্পষ্ট বেরিয়ে আসে অনলাইনেই। এরা নিজেরা সুস্থ নয়, এরা কাউকে সুস্থ থাকতে দিতেও রাজি নয়।

লিখতে লিখতে ক্লান্তি বোধ করি। এই লেখাটি প্রকাশিত হবে। এরপর এই লেখার লিংকের নিচে আমাকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল কুকথার জোয়ার বয়ে যাবে। লেখা, সে যে বিষয়েরই হোক, লেখক যিনিই হন, গালাগালি চলবে।

কেউ পড়ে দেখবে না একটা বাক্য কি শব্দ। কিন্তু লেখককে হত্যা ধর্ষণ অপহরণ- সব ধরনের হুমকিও দেয়া যাবে অনায়াসে। হ্যাঁ, অনায়াসে। একটি স্বাধীন দেশে বসে এভাবে এক শ্রেণির বিকৃত মানুষ বিকৃতি আর নোংরামির চর্চা চালিয়ে যাবে। কেউ তাদের টিকিটাও ছুঁতে পারবে না।

এ তো গেল অনলাইনের কথা। প্রকাশ্য রাজপথে আন্দোলনরত মেয়েকে দশ বিশজন পুরুষ মলেস্ট করবে। সেই ছবি ভাইরাল হবে সোশ্যাল মিডিয়াতে। মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশ হবে ছবি। তবু ক্ষমতাসীন রাজনীতির ছায়াতলে দাঁড়িয়ে আম কাঁঠাল খাওয়া এই যৌনহয়রানিকারী ধর্ষকদের টিকি কেউ ছোঁবে না। সে সাহস কারো নেই।

দিন দিন দেশ নিয়ে হতাশা বেড়েই চলেছে আমার। অথচ এই দেশকে ভালবেসে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চেয়েছি। শত সমস্যাতেও দেশ ছাড়িনি। সন্তানের জন্ম দিয়েছি। তাকে বড় করতে চেয়েছি এই মাটিতে।

আজ বড় মিথ্যে আর ভুল মনে হয়। আজ বড় অহেতুক মনে হয় এই দেশপ্রেম। এই দেশ আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনা। সম্মান দিতে পারে না। তবে কী দেয় এই দেশ আমাকে? উন্নয়নের আশ্বাস?

যে আশ্বাসে আর প্রতিশ্রুতিতে ভুলে বছরের পর বছর আমরা কাটিয়ে দিই একটি যানজটে স্থবির নোংরা কদর্য শহরে! যে শহরে আমার সন্তান দু’দণ্ড ছুটে বেড়াতে পারে না। যে শহরে আমাকে সন্তানের জন্য খাবার কিনতে গিয়ে কিনে আনতে হয় বিষের কৌটা! যে শহরে আমাকে আর আমার সন্তানকে অ্যাবিউজ করতে ওৎ পেতে থাকে বিকৃত পুরুষেরা। এবং এসবের কোন বিচার হয় না।

কর্মক্ষেত্রের লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখি। পনেরো তলা বিল্ডিংয়ে নানা কাজে আগাগোনা করা মানুষ দেখি। ধান্ধা দেখি। তাদের প্রত্যেকের চোখ আমার সর্বাঙ্গে খেলে বেড়ায়। যত নারী সেখানে উপস্থিত, প্রত্যেককে দেখে দেখে তারা তাদের অবদমনের সুখ খুঁজতে চায়।

ফাঁকে ফাঁকে থু থু করে থুতু ফেলে। বিকট শব্দে নাক ঝাড়ে। তারপর লিফট এলে হুড়োহুড়ি করে ওঠে, ধাক্কাধাক্কি করে, একে অন্যকে গাল দেয়। তারপর চিৎকার করে কথা বলে, ফোন করে। কারো ভেতরে সৌন্দর্যের বিন্দুমাত্র প্রকাশ দেখি না।

আমাদের জীবন থেকে সৌন্দর্যরা হারিয়ে গেছে। আমরা কেউ আর সুন্দর না। একটি অসুন্দর নোংরা নগরের অসুন্দর নোংরা নগরবাসী আমরা। আমাদের জীবন আটকে গেছে ধান্ধাবাজিতে, অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। আমরা শুধু হা করে আছি খাবো বলে। খাওয়া আর আত্মতৃপ্তির অসুস্থ লোভ আমাদের গ্রাস করেছে।

আমি আর কোন আশা দেখি নাহ!

লেখক : কলামিস্ট।