অস্ট্রেলিয়ায় বিদেশি ছাত্রীদের ৬০% ধর্ষণের শিকার

লিউ যখন চীন থেকে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা পড়তে যাচ্ছিল, তখন তিনি জানতেন না যে তার ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে! তিনি মনে করতেন, সেখানে অনেক লম্বা লম্বা সাদা মানুষ দেখবেন তাদের মধ্যে কিছু খাটো মানুষ দেখে মজা পাবেন। চিন্তাছিল সহজ সরল। কিন্তু, সেখানে পৌঁছে ধারণাটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেলো। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। সেখানে যে শিক্ষার্থীরা এত বেশি মদ পান করে তা জানা ছিল না।

ক্যানবেরায় পৌঁছে অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভারসিটিতে পড়াশুনা শুরু করেন লিউ। তিনি বলেন, সেখানকার অভিজ্ঞতা আমার এতটা ভয়াবহ ছিল যে, মাঝে মাঝে রাতে দুঃস্বপ্নে জেগে উঠি।

এক রাত: লিউ বলেন, সকালে বাসা থেকে বেরনোর সময়ই তার এক বন্ধু পিছু নেয়, সারদিনই সে যেখানে যেখানে যায় সেও তাকে অনুসরণ কওে সেখানে যায়। বাসায় ফেরার পর ওই ছেলে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে!

‘আমাকে বিছানার ওপর ফেলে দেয় এবং ধর্ষণ করে…। আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি সাহায্যের জন্য অনেক চিৎকার করেছি, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। আমি নিজেকে নিরাপদ করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।’

বিদেশি শিক্ষার্থীরা জানে না কীভাবে সাহায্য পাবে : এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শুধু ২০১৭ সালেই অস্ট্রেলিয়াতে পড়তে যাওয়া প্রায় পাঁচ লাখ বিদেশি শিক্ষার্থী ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের মত নানা অপরাধের শিকার হয়েছেন। অথচ দেশটির তৃতীয় বৃহৎ রফতানি খাত হলো ‘আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ব্যবস্থা’। যেখন থেকে প্রতি বছর ১৮ বিলিয়ন ডলার আয় করে। কিন্তু দিন দিন দেশটির ‘নিরাপদ শিক্ষার স্থান’ সুনাম তা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।

দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি শিক্ষার্থীরা ভয়, নিরপত্তাহীনতা ও লজ্জার কারণে যৌন হয়রানির কথা বলতে চায় না। পুলিশের কাছে অভিযোগ করে না।

মেলবোর্নে বিদেশি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার কর্মী অ্যালিসন কোয়েলহো বলেন, “আমি মনেকরি বিদেশি শিক্ষার্থীরা ‘সফট টার্গেট’। তাই দুর্বৃত্তরা ‘সফট টার্গেট’দের বেশি হামলা করে। কারণ, তারা কারো সহযোগিতা পায় না।”

ভারত, চীন এবং ফিলিপাইনের কয়েকজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানান, দোষীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। এর কারণ সমাজিকতা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার আইন।

তারা বলছে, তাদের উপর যে কালিমা লেপন হয়েছে এটা তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। যার কারণে তাদের পরিবারকেও জানাতে পারছে না। স¤প্রতি স্নাতক শেষ করা ২৫ বছর বয়সী নিশি বলেন, ‘এখন নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে।’

‘কারণ আমার সারাজীবন এই কালিমা নিয়ে চলতে হবে। এটা আমার সমাজ মেনে নেবে না। কাউকে বলতে পারবো না। পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি মেলে না।’

বিদেশি শিক্ষার্থীরা খুব কমই যৌন হয়রানির অভিযোগ করে : কোয়েলহো বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীরা খুব কমই যৌনহয়রানির অভিযোগ করতে পুলিশের কাছে যায়।’

লিউ জানান, বিদেশি শিক্ষার্থীরা নানা শঙ্কায় পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ করে না। ‘কেন আমরা অভিযোগ করতে যাবো? অস্ট্রেলিয়ার আইনতো তাদের জনগণকে রক্ষার করে। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ করলে হয়তো নিজেরই ছাত্রত্ব বাতিল হবে।’

যদিও লিউ পুলিশের কাছে অভিযোগ কারতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন. ‘আমি পুলিশের কাছে গেলে ভদ্র মহিলা পুলিশ অফিসার সব শুনে আমাকে বললেন, পরবর্তীতে সাবধানে থাকবেন!’

‘আমি বললাম, আমিতো আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি, আপনি আমাকে সাবধানে থাকতে চলছেন কেন? তিনি এর বেশি কথা বলতে রাজি হয়নি।’
লিউ বলেন, এরপর তিনি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ করেননি।

‘আমি মনেকরি অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব বেশি সহযোগিতা করেনা’

অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যৌন হয়রানির অভিযোগের তথ্য কাউকে দেয় না। তারপরও নানা মাধ্যমে জানাগেছে ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সেখানে ৫৭৫টি অভিযোগ পড়েছে।

যৌন হয়রানির মিথ্যা অভিযোগ করলে বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগকারীর ছাত্রত্ব বাতিল করতে পারবে এমন আইন থাকায় শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেনা বলে জানায় মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

এদিকে, ৫৭৫টি অভিযোগের মধ্যে মাত্র ছয়জন অপরাধীর ছাত্রত্ববাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাঁকিদের কাউকে খালাস দেওয়া হয়েছে, কাউকে কাউকে নানা মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

আরএমআইটি ইউনিভারসিটির অপরাধ বিষয়ক অধ্যাপক অ্যানাস্টাসিয়া পলওয়েল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জাতীয় পর্যায়ের একটি চুক্তির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধাণে আসা প্রয়োজন।

মেলবোর্নের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি স্নাতক শেষ করা এমা হান্ট বলেন, তিনি ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি।
এত অভিযোগ আর হতাশার পর একটি আশার বাণি হলো সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসির মাধ্যমে অ্যান্টি-হ্যারেসমেন্ট গ্রুপ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের কাজ হলো শিক্ষার্থীরা যৌনহয়রানির শিকার হলে তাদের সবধরণের সহযোগিতা দেওয়া।

তেমনি একটি গ্রুপের চেয়ারপারসন মার্গারেট গ্রান্ডার বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের সমাজে যৌন হয়রানি একটি মারত্মক ব্যাধি। আমরা চেষ্টা করছি সব ভুক্তভোগীর কাছে পৌঁছাতে।’ সূত্র: আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান।