আইসিটি আইনের ৯৭% মামলা ভুয়া, বিচারের আগেই ‘সাজা’

নায়িকা মাহিয়া মাহী এবং শাওনের কথা সবারই মনে আছে। ২০১৬ সালের মে মাসের ঘটনা। মাহীর বিয়ের পরপরই আরেক স্বামী শাওনের দেখা মেলে। মাহী ও শাওনের বিয়ের ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়।

এ ঘটনায় ২০১৬ সালের ২৮ মে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় নায়িকা মাহী শাওনের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে (আইসিটি) মামলা করেন। সেই মামলায় গ্রেফতারের পর শাওনকে পুলিশ রিমান্ডে নেয়। ১৯ দিন হাজতবাসের পর সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন পান তিনি।

পরের পর ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারি এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেখানে শাওনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। পরে ২৫ এপ্রিল আদালত শাওনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

গতকাল বুধবার এমনই আরেকটি মামলার রায় হয়েছে। সেখানেও আসামি রমেশ রায় ও লক্ষন কুমার মণ্ডলকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক।

তাদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি বাগেরহাটের মোংলা থানায় আইসিটি আইনে মামলা হয়।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, পার্থ সারথী বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ নামক ফেসবুক আইডি থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে আপত্তিকর পোস্ট করা হয়। আসামি রমেশ রায় ওই পোস্টে লাইক দিয়ে মন্তব্য করেন, ‘সালাম আপনাকে’। আর লক্ষন কুমার রায় সেই পোস্টের মন্তব্যে লেখেন, ‘চিরন্তন সত্য কথা বলিয়াছ’।

মামলার বাদী মোংলার উপজেলা আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আরিফা খাতুনের দাবি, তাদের এই লাইক ও মন্তব্যে মুসলমান ধর্মের মানুষের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।

এই মামলায় দীর্ঘ সাড়ে ৬ মাস জেলখাটার পর ২০১৭ সালের আগস্টে রমেশ ও লক্ষন আদালত থেকে জামিন পান। পরে চলতি বছরের ১৫ মার্চ এ মামলায় ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্টে জানানো হয়, পার্থ সারথী বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ লক্ষন রমা ও রমেশ রায়ের ফেসবুক আইডির কোনো লিংক না থাকায় তাদের সনাক্ত করা যায়নি। বাদী ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে বিবাদীদের বিরুদ্ধে এ মামলা করেছেন। এরপর গতকাল বুধবার (৩১ অক্টোবর) সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেন।

অব্যাহতি পাওয়ার পর লক্ষন কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমি নির্দোষ ছিলাম, ন্যায়বিচার পেয়েছি। কিন্তু, এই মামলার কারণে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। গুজবের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে আমার নামে মামলা দেয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘রিমান্ডের ভয় দেখিয়ে স্থানীয় এক নেতা ৩০ হাজার টাকা নেন। ৬ মাস জেল খাটার পর আনসারের (অস্থায়ী) চাকরিটা চলে গেছে। এ ক্ষতিতো আমাকে কেউ পুষিয়ে দেবে না।’

নায়িকা মাহীর অভিযোগও ‘মিথ্যা’

বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে ফেসবুকে ছবি প্রকাশের জের ধরে ২০১৬ সালের ২৮ মে উত্তরা পশ্চিম থানায় নায়িকা মাহিয়া মাহী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করেন। এই মামলায় গ্রেফতার হন শাওন। দু’দিনের রিমান্ড শেষে ৩১ মে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত। ১৯ দিন হাজতবাসের পর ওই বছরের ১৬ জুন সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল শাওনের জামিন মঞ্জুর করেন।

এই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১৫ মে নিকাহ রেজিস্ট্রার মো. সালাউদ্দিনের মাধ্যমে শাওন ও মাহীর বিয়ে হয়। বিয়ের এক মাসের মধ্যে মাহী চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করায় তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। এরপর তারা আলাদা থাকা শুরু করেন।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পরে তাদের মধ্যে খোলা তালাক হয় মর্মে পারিবারিক সূত্রে জানা যায়। বিয়ের পর উভয়ের অন্তরঙ্গ ছবি শাওনের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট হয়েছে, যা তিনি সরল বিশ্বাসে করেছেন। বাদী মাহী অন্যত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সময় ছবিগুলো নজরে আসায় ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির মাধ্যমে মামলাটি দায়ের হয়।

২০১৭ সালে ২৯ জানুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তা এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। পরে ২৫ এপ্রিল আদালত শাওনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন।

শুধু রমেশ, লক্ষন ও শাওন নন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে দায়ের হওয়া মামলার ৯৭ ভাগেরই অভিযোগ বাদীপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন করার সময় থেকেই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এরপর এই আইনের অধীনে সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত মামলার বিচারে ২০১৩ সালে গঠন করা হয় সাইবার ক্রাইম ট্রাইবুনাল।

বিগত পাঁচ বছরে সাইবার অপরাধের অভিযোগে দেড় হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। কিন্তু, আদালতের নথি ঘেটে দেখা গেছে, এই আইনে দায়ের করা অধিকাংশ মামলায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে মিথ্যা ও সত্যতা নেই মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মোট ৩৬৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। যে ৭৪টি মামলার রায় হয়েছে, তাতে মাত্র ১০টি মামলার আসামিরা শাস্তি পেয়েছেন। বাকি ৬৪টি মামলার আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছেন এবং ৫১টি মামলার আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন। আর ২৪০টি মামলার অভিযোগ মিথ্যা মর্মে তদন্ত কর্মকর্তারা ট্রাইব্যুনালে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দাখিল করেছেন।

পরিসংখ্যান বলছে, চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া ৯৭ ভাগ মামলার অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি।

ঢাকায় অবস্থিত একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনালের নথি থেকে জানা গেছে, রায় হওয়া ৭৪টি মামলার মধ্যে ২০১৩ সালে সাজা এবং খালাসের কোনো রায় ছিল না। ২০১৪ সালে সাক্ষ্য-প্রমাণের পর ৪টি মামলায় রায় হয়, যার ৪টিতেই আসামিরা দণ্ডিত হন।

২০১৫ সালে রায় হওয়া ৬টি মামলার মধ্যে একটি মামলায় দণ্ডিত এবং ৫টি মামলায় আসামিরা খালাস পান। ২০১৬ সালে ২১টি মামলায় রায় হয়, যার ১৭টিতে আসামিরা খালাস পান, ৪টিতে দণ্ড হয়।

২০১৭ সালে রায় হওয়া ২৩টি মামলার আসামিরাই খালাস পেয়েছেন। আর ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে গত ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ১৮টি মামলায় রায় হয়েছে, এর মধ্যে মাত্র একটি মামলায় আসামিরা দণ্ডিত হয়েছেন।

এ ছাড়া চলতি বছর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের আরো ৪৩টি পিটিশন মামলা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩টি মামলা নিয়ে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর আসে ৩২টি মামলা। এরপর ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি ও ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য এসেছে ৫৬৭টি মামলা। অর্থাৎ বিগত পাঁচ বছরে এই ট্রাইব্যুনালে মামলা এসেছে মোট ১ হাজার ৫৫৫টি।

ট্রাইব্যুনালে আসা ১ হাজার ৫৫৫টি মামলার মধ্যে বর্তমানে ১ হাজার ৮৮টি বিচারাধীন। অন্য ৪৭৩টি মামলার মধ্যে ১০৮টি অন্য আদালতে বিচারকাজ হওয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকি ৩৬৫টি মামলা আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে।

এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২৪০টি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট (এফআরটি) দিয়েছে পুলিশ। গত ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ১১০টি মামলায় এফআরটি মঞ্জুর করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

বিচারের আগেই শাস্তি

তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের অধিকাংশ মামলার আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও দায়রা জজ কোর্ট জামিন দেন না। তাদের হাইকোর্ট থেকে জামিন নিতে হয়। এক্ষেত্রে তাদের ৩ থেকে ৬ মাস লেগে যায়।

কিন্তু, পরে মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক প্রমাণিত হওয়ায় আসামিরা খালাস ও অব্যাহতি পাচ্ছেন। এসব মামলায় বিচারের আগেই অনেককে হাজত খাটতে হচ্ছে— সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা এটিকে বিচারের আগেই সাজা উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

তবে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের অধিকাংশ মামলা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মানতে নারাজ সাইবার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম শামীম।

তিনি পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বেশিরভাগ মামলায় বাদী এবং আসামিদের মধ্যে আদালতের বাইরে আপস হচ্ছে। বাদী আদালতে এসে এমনভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, যার কারণে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। খালাসের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক সময় তদন্তের ত্রুটির কারণেও অনেক আসামি খালাস পাচ্ছেন।’

এ বিষয়ে ক্রিমিনাল আইনজীবী ও ঢাকা কোর্ট রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মনজুরুল আলম বলেন, ‘সাংবাদিক সমাজ ও মানবাধিকার কর্মীরা আগেই এ আইনের মামলায় হয়রানি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, সাইবার ট্রাইবুনালে নিষ্পত্তিকৃত ৩৬৫টি মামলার মধ্যে বিগত পাঁচ বছরে মাত্র ১০টি মামলায় সাজা হয়েছে। এর মানে অধিকাংশ আসামিরা বিনা দোষে হয়রানির শিকার হয়েছেন।’

আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সদ্য হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার ক্ষেত্রেও আমরা এমন পরিণতির আশঙ্কা করছি।’ মনজুরুল আলম বলেন, ‘এসব আইনের মামলাগুলো জামিনযোগ্য এবং মিথ্যা প্রমাণিত হলে সাজার বিধান করা প্রয়োজন। তাহলে হয়তো মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ হবে।’-খবর পরিবর্তন ডটকমের সৌজন্যে।