আদালতে দুর্নীতি হচ্ছে : অ্যাটর্নি জেনারেল

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের বিচার বিভাগের অবক্ষয় ঘটেছে। সাধারণ জনগণের কাছে এ আদালতের যে ভাবমূর্তি ছিল তাতে পরিবর্তন এসেছে। আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভেতরে একটি বিরাট অংশ ইতিমধ্যে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।’

রবিবার নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল এসব কথা বলেন।

মাহবুবে আলম বলেন, ‘আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভেতরে একটি বিরাট অংশ ইতিমধ্যে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন এবং যারা এখনো সৎ আছেন এভাবে চলতে থাকলে তাদের পক্ষেও সততা বজায় রাখা কঠিন হবে।’ তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে ভয়াবহ যে বিষয়টি, তা হলো বিশেষ বিশেষ কোর্টের, বিশেষ বিশেষ আইনজীবীর কোর্ট হয়ে গেছে এবং অনেক সময় অনেক সিনিয়র অ্যাডভোকেটের কাছ থেকে ব্রিফ নিয়ে তাদেরকে নিয়োগদান করা হচ্ছে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বিচারপ্রার্থী ব্যক্তিরা অনেকে জেনে গেছেন, কোন কোর্টে কাকে নিয়ে গেলে মামলা জেতা যাবে। এটাতো ন্যায়বিচারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ বিষযে অনেকেই ছুটছেন বিচারপতিদের সন্তান, স্ত্রী যারা আইনজীবী হিসেবে নিয়োজিত আছেন তাদের দিকে। তাদের চিন্তা হলে, এদেরকে নিয়ে গেলে হয়ত মামলায় জেতা যাবে। বিচারপতিদের আত্মীয় বা সন্তানরা আগেও এ পেশায় ছিলেন, কিন্তু কখনো এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি, এখন কেন বিচারপ্রার্থীদের আচরণ এরূপ হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।’

মাহবুবে আলম বলেন, ‘ইতঃপূর্বে একজন প্রধান বিচারপতিকে এই আদালতে সংবর্ধনা দেওয়ার সময় আমি এ আদালতের অবক্ষয়ের কিছু নমুনা তুলে ধরেছিলাম এবং আমার এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তদন্তের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তদন্ত অনেকটা অগ্রসরও হয়েছিল। কিন্তু যখন পরবর্তী প্রধান বিচারপতি এলেন, উনার দপ্তর থেকে সেই ফাইলটি নিখোঁজ হয়ে গেল। ’

সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘সংবিধানের বিধানমত আপনি ২০২১ সনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির পদে আসীন থাকবেন। এ সময়টা একটি দীর্ঘ সময়, প্রায় চার বছর। আমাদের বিচার বিভাগের বর্তমানের যে অবস্থা, আপনার এই সময়কালে তাতে আপনি আমূল পরিবর্তন আনতে পারেন, যদি এ বিষয়ে আপনি দৃঢ়ভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন।’

মাহবুবে আলম বলেন, ‘চার বছর আগে দায়ের করা মামলা লিস্টে বহাল তবিয়তে আছে, অথচ দুই মাস আগে দায়ের করা মামলা চূড়ান্ত শুনানি হয়ে যাচ্ছে। আদালতের কিছু অসাধু কর্মচারী মামলা নিচের থেকে উঠানোর কাজ করে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। কিছু মামলা শুনানি করা যাচ্ছে না। আবার কিছু মামলা শুনানি হয়ে যাচ্ছে রকেট গতিতে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমরা যখন এই আদালতে ঢুকলাম তখন দেখেছি একটি মামলা শুনানি হয়েছে এবং তার রায় দেওয়া হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। কালে-ভদ্রে দুই একটি মামলা রায়ের জন্য সি.এ.ভি করে রাখা হতো এবং আগের মামলার রায় শেষ হওয়ার পরে পরবর্তী মামলাটি ধরা হতো। এখন দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো আদালতে বিনা নোটিশে মামলা আংশিক শ্রুত হচ্ছে। অনেক মামলা শুনানির পরে রায় দেওয়া হচ্ছে না দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। আবার দেখা যায় মামলার রায় হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হচ্ছে না মাসের পর মাস।’

দেশের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘আদালতে যোগদানের পর দেখেছি সকাল সাড়ে দশটায় ঠিক কাঁটায় কাঁটায় অনেক বিচারপতি এজলাসে বসতেন এবং কোর্টে আসীন হওয়া ও কোর্ট থেকে নেমে পড়ার ব্যাপারে কজ লিস্ট-এ যে সময় দেওয়া আছে তার কোন ব্যত্যয় হতো না। কিন্তু এখন কজ লিস্ট-এর যে সময় ধার্য করে দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে বিচারকদের আদালতে ওঠা বা নামার কোনোই সঙ্গতি নেই। এ অবস্থা চললে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।’

‘কোনো কোনো বেঞ্চে বিচারপতিরা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তার বেঞ্চ অফিসারের উপরে এবং আইনজীবীদের কথায় তারা কোনো কর্ণপাত করেন না। বরং তারা পরিচালিত হন তাদের বেঞ্চ অফিসারদের প্রভাবে। ইতিমধ্যে একজন বিচারপতি অবসরে গিয়েছেন। তার প্রতিটি মামলার রায়ই ছিল একই রকম বাক্যসমৃদ্ধ এবং অনেকে হাসাহাসি করতো এই কথা বলে যে, তার হয়ে রায় লিখে দিচ্ছে তার বেঞ্চ অফিসার। এছাড়াও তিনি অবসরে যাবার পূর্বে মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুত না হওয়া এবং কজ লিস্টে মামলাটি না থাকা সত্ত্বেও রায় প্রদান করেন। কোনো কোনো বিচারপতি মামলা কজ লিস্টে না এনেও জামিন বা স্থগিত আদেশ প্রদান করছেন যা ইতিমধ্যে আপনাদের দৃষ্টিগোচরে এসেছে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?’ বলেন তিনি।

মাহবুবে আলম বলেন, ‘ইতিমধ্যে আদালতের রায় নিয়ে জাল জালিয়াতি শুরু হয়ে গেছে। আদালত থেকে জামিন দেওয়া হয়নি অথচ জামিনের কাগজ তৈরি করে আসামিরা জেল থেকে বেরিয়ে গেছে। কীভাবে ইনফরমেশন টেকনোলজিকে আদালতের কাজে আরও ব্যবহার করা যায়, সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই আপনি ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি। ফৌজদারি মামলার জামিনের শুনানির ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। নিয়ম করা উচিত, যে আদালতে জামিনের জন্য প্রার্থনা করা হবে, সে আদালতে ডিউটিরত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বা সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের কাছে কপি প্রদান করা, যাতে তারা মামলাটির ব্যাপারে আদালতকে সাহায্য করতে পারেন। এখন যে বিধান আছে যে, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কপি সার্ভ করা, বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিধান পরিবর্তন হওয়া দরকার।’

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি ঢালাওভাবে হাইকোর্টের সমস্ত বেঞ্চের জন্য একথা বলছি না। অনেক বিচারকই বিচারকার্য হাতের মুঠোয় রেখেছেন এবং আদালতের কর্মকর্তারা তাদের কথা মতো কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সঠিকভাবে ও আইনজীবীদের প্রত্যাশা মতো তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কতিপয় বিচারপতির আদালত চালানোর অব্যবস্থা দ্বারা সমস্ত বিচারালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তার কারণ, সুগন্ধের পরিধি হয় সীমিত অথচ দুর্গন্ধের পরিধি হয় বিস্তৃত।’

মাহবুবে আলম বলেন, ‘ইদানীং ষোড়শ সংশোধনী মামলায় সরকার হেরে গিয়েছে সত্য, আমার বিবেচনায় সরকার হেরেছে, কিন্তু ইতিহাস জিতেছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে তৎকালীন সরকার যেহেতু চায়নি বিচার হোক, সেজন্য বিচারই শুরু হয়নি। যখন বিচার শুরু হলো, এ আদালতেরই অনেক বেঞ্চ মামলা শুনতে চায়নি এবং সে সময়ে কোনো রায়ে বঙ্গবন্ধুর নামও উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে প্রত্যেক বিচারক বঙ্গবন্ধুকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামে’ উল্লেখ করেছেন এবং জাতির পিতা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘ইতিমধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণাসংক্রান্ত মামলায় এই আদালত দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে যে, বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক এবং এই রায় ঘোষণার পর থেকে এ বিষয়ে কূটতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।’