আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চলছে না, আতঙ্কে সাক্ষীরা

চেয়ারম্যান না থাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম। কোরাম সংকটের কারণে রায়ের অপেক্ষায় থাকা একটি মামলার রায় ঘোষণা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আর ঝুলে আছে ৩৩ মামলার কার্যক্রম।

বিচার কার্যক্রম না চললেও কারাগারে বন্দি আছেন ৮৮ আসামি। আসামিদের বয়স ৭০ থেকে ৮০ বছর। প্রত্যেকে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন বলে দাবি করেছেন তাঁদের আইনজীবী।

শুধু তাই নয়, মামলার কার্যক্রম না থাকায় আতঙ্কে রয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের (প্রসিকিউশন) সাক্ষীরা। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম না থাকায় এরই মধ্যে সাতটি মামলার সাক্ষীদের দীর্ঘদিন ঢাকায় রাখার পর গ্রামের বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। গ্রামে চলে যাওয়ায় এই সাক্ষীদের আবার হাজির করা কঠিন বলে আশঙ্কা করছে রাষ্ট্রপক্ষ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে তিনজন বিচারপতি ছাড়া রায় ঘোষণার সুযোগ নেই। গত ১৩ জুলাই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক মারা যান। এর পর এক মাস পেরিয়ে গেলেও ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর আগে তিনি অসুস্থ থাকায় দীর্ঘদিন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ ছিল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্টার অফিস সূত্রে জানা যায়, ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি আনোয়ারুল হক মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগে থেকেই কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তিনি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের দুই বিচারপতি শুধু বিভিন্ন মামলার নতুন তারিখ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এখনো সে রকমই। কোনো কার্যক্রম শুরু করতে পারছেন না। ট্রাইব্যুনালের নিয়ম অনুযায়ী কোনো রায় বা মামলার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হলে তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে কোরাম পূরণ করতে হয়। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক মারা যাওয়ার পর থেকে কোরাম সংকট দেখা দিয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের রেজিস্টার অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে ৩৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি সাক্ষ্য পর্যায়ে, ১০টি মামলার অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে এবং ১৬টি মামলার শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া একটি মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা দেড় শতাধিক। এর মধ্যে ৮৮ আসামি কারাগারে আটক রয়েছেন।

নিয়ম অনুযায়ী আইন মন্ত্রণালয় থেকে ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি নিয়োগে প্রধান বিচারপতির কাছে সুপারিশের জন্য চিঠি পাঠানোর কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো চিঠি পাঠানো হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ। বুধবার তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে বিচারপতি সংকট রয়েছে। প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের কাছে ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি নিয়োগে চিঠি পাঠালে সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে।

ট্রাইব্যুনালের অচলাবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার কেশব রায় চৌধুরী বলেন, ‘চেয়ারম্যান মারা যাওয়ার পর থেকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম অকেজো অবস্থায় রয়েছে। এখানকার সব কর্মকর্তা-কর্মচারী রুটিন অনুযায়ী শুধু অফিস করে যাচ্ছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ত্বরান্বিত করতে শিগগিরই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া উচিত।’

ডেপুটি রেজিস্ট্রার আরো বলেন, ‘আমাদের চেয়ারম্যান যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন থেকেই ট্রাইব্যুনাল অকেজো। নিয়ম অনুযায়ী তিনজন রায় দিতে হয়। দুজন শুধু শুনানি। একেবারে স্থবির অবস্থা চলছে। টুকটাক কাজ চলছে।’

এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের অন্তত ২০টি মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান না থাকায় বিচারপ্রার্থী ও আসামি উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বিচারহীনতায় অনেক বয়স্ক আসামি দিনের পর দিন জেলে পড়ে আছেন। বর্তমানে আটক আসামিদের সবাই ৭০ থেকে ৮০ বছর বয়সের। সবাই বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল বন্ধ থাকায় বিচার চাওয়ার জায়গা নেই। জামিন চাওয়া যাচ্ছে না। এ অচলাবস্থার নিরসন হওয়া উচিত।’

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম না থাকায় প্রসিকিউটরের সদস্যরা অলস সময় পার করছেন। অন্যদিকে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ আসামি রয়েছেন, যাঁরা বিচারহীনতার কারণে দিনের পর দিন কারাগারে রয়েছেন। তাঁদের মামলার কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।’

তুরিন আফরোজ জানান, বর্তমানে চিফ প্রসিকিউটরসহ মোট ১৮ জন রাষ্ট্রপক্ষ প্রসিকিউটর রয়েছে। তিনি বলেন, ‘যদি নতুন করে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ থাকা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ জামায়াতের সাবেক এমপি আবদুল আজিজ (ওরফে ঘোড়ামারা আজিজের) মামলাটির কার্যক্রম আবার শুরু করতে হবে। অর্থাৎ আইন অনুযায়ী এ মামলার যুক্তিতর্ক পুনরায় করতে হবে।’

ট্রাইব্যুনালের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, আইন মন্ত্রণালয় ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

চলতি বছর সাত বছর পূর্ণ করল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। নানা প্রতিকূলতা ও বাধা পেরিয়ে দীর্ঘ এ সময়ে ট্রাইব্যুনাল ২৯ মামলায় অর্ধশতাধিক আসামির বিচার শেষে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ছয় যুদ্ধাপরাধীর চূড়ান্ত দণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাঁরা হলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা, সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের ৯০ বছরের দণ্ড মাথায় নিয়ে বন্দি অবস্থায় মারা গেছেন গোলাম আযম। আমৃত্যু কারাদণ্ড নিয়ে কারাগারে আছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।

তদন্ত সংস্থায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে ৫৩১টি। তবে প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় ধীরগতিতে এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে ১৯টি আপিল। তবে সাত বছরে এসে ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমে এখন অনেকটা অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, শীর্ষ অপরাধীদের বিচার শেষ হয়ে যাওয়ায় ট্রাইব্যুনালের এখন আর সেই জৌলুস নেই।

২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন করে ট্রাইব্যুনাল-২ নিষ্ক্রিয় করা হয়। এর কারণ সম্পর্কে তখন আইন মন্ত্রণালয় জানায়, মামলার সংখ্যা কম থাকায় একটি ট্রাইব্যুনাল নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। তবে এটি বিলুপ্ত হচ্ছে না। প্রয়োজন হলে আবার এটিকে সক্রিয় করা হবে।

প্রথম ট্রাইব্যুনাল গঠনের দুই বছর পর বিচারে গতি আনতে ২০১২ সালের ২২ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। সাত বছরে তদন্ত সংস্থা ৪৯টি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এখনো বিপুলসংখ্যক (৭৫ জন) সাজাপ্রাপ্ত আসামি পলাতক। তাদের গ্রেফতারে পুলিশের যথাযথ তৎপরতা নেই।

এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুম বলেন, ‘চুয়াল্লিশ বছর পর বিচার শুরু হয়। এতে দেশের শহীদ পরিবারগুলো আশায় বুক বাঁধে। এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে ২৯টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এ ছাড়া তদন্ত সংস্থা প্রতি মাসে তিন থেকে চারটি নতুন করে প্রসিকিউশনে জমা দিচ্ছে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল বন্ধ। আমরা মনে করি, ট্রাইব্যুনালকে সচল করা উচিত।’ তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক মারা যাওয়ার পর পাঁচটি মামলার সাক্ষীকে প্রসিকিউশন টিম দীর্ঘদিন ঢাকায় রাখার পর গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই সাক্ষীদের পরবর্তী সময়ে হাজির করা কঠিন হয়ে পড়বে। কেননা, দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে। গ্রামে গিয়ে সাক্ষীরা প্রতিনিয়ত ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।সূত্র : এনটিভি অনলাইন।