আমরা কোন প্রহসন চাইনা, আমরা চাই সরাসরি বিচার

চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর সিডিএ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. সাইদুর রহমান পায়েল ছিল রাজধানীর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি’র বিবিএ পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও সানশাইন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর তাকে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনার জন্য পাঠাতে চেয়েছিলেন তার বাবা-মা। কিন্তু পায়েল দেশেই পড়াশুনা করবেন বলে ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন।

গত ২১ জুলাই’১৮, শনিবার রাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে হানিফ পরিবহনের বাস থেকে নিখোঁজ হন পায়েল। পরে জানা যায় পায়েলকে ঘাতকেরা অচেতন অবস্থায় নাকমুখ থেঁতলে সেতু থেকে খালের পানিতে ফেলে দেয়।

জ্যামের মধ্যে গাড়ি যখন অনেক্ষণ ধরে দাঁড়ানো ছিলো তখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ড্রাইভারকে বলে হানিফ পরিবহন থেকে নামেন পায়েল। কিন্তু তাকে না তুলে ঘাতক ড্রাইভার জামাল হোসেন(৩৫) গাড়ি ছেড়ে দিলে দৌঁড়ে বাসে উঠতে গিয়ে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় সে। পড়ে যাওয়ার সাথেসাথে তার নাকমুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে অজ্ঞান হয় সে। হেলপার জনি(৩৮) বাস থেকে নেমে পায়েলের অবস্থা দেখে ড্রাইভারকে বলতে যায়। নরপশু ড্রাইভার জামাল হোসেন পায়েলকে কোন হাসপাতালে না নিয়ে বা চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে দুর্ঘটনার ‘দায় এড়ানোর জন্য’ হেলপার জনির সহায়তায় অজ্ঞান পায়েলকে পানিতে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। ২৩ জুলাই’১৮, সোমবার মুন্সিগঞ্জ উপজেলার গজারিয়ার ভাটেরচর সেতুর নিচের খাল থেকে পায়েলের মৃতদেহ উদ্ধার করেন পুলিশ।

কি অপরাধ ছিল পায়েলের? কেন তাকে এই করুণ পরিনতির শিকার হতে হয়েছে? কোন সাহসে, কিসের ক্ষমতায়, কার ভরসায় এ নরঘাতকেরা এ পাপ করার কথা ভাবতে পেরেছে বা করেছে? কে দিয়েছে তাদের এ বুকের পাটা?

পায়েলের মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতেই, এ হত্যার বিচারের কোন সুরাহা হতে না হতেই ঘাতকেরা আবারও গত রোববার, ২৯ জুলাই’১৮, দুই বাসের রেষারেষির সময় সর্বোচ্চ ঘৃণিত কাজটি করলো। ঢাকা রেডিসন ব্লু হোটেল সংলগ্ন কুর্মিটোলায় উড়ালসেতুর ঢালে রাস্তার পাশে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের উপর চলন্ত বাস তুলে দেয় ‘জাবালে ন‚র পরিবহন’ এর ঘাতক ড্রাইভার। এতে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত এবং আরও নয়জন শিক্ষার্থী আহত হয়। আহত শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। নিস্পাপ দুই শিক্ষার্থীকে বাসের চাকায় পিষে মারার ঘটনার ম‚ল ঘাতক ড্রাইভারকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে আদালতকে জানিয়েছে পুলিশ। সেদিন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বাসগুলোর মধ্যে চারজনের নাম জানার পর র‌্যাবের সহায়তায় তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। তবে ম‚ল ঘাতক ‘জাবালে ন‚র পরিবহনের’ বাস চালক এখনো পলাতক।

এখন প্রশ্ন হলো, – আমরা কি নিরাপদ ও সুন্দরভাবে এদেশে মৃত্যুবরণ করতে পারবো? রাস্তাঘাটে, ঘাতকদের আঘাতেই কী এদেশের মানুষ মরবে? এখন কি আমাদের শ্লোগান হবে নিরাপদ মৃত্যু চাই?

আমরা ঘর থেকে বের হয়ে যে সুস্হভাবে ফিরবো এর কোন গ্যারান্টি নেই!

এই শিক্ষার্থীদের জায়গায় আমি, আপনি, আমার বা আপনার প্রিয়জন, স্বজন যে কেউই তো থাকতে পারতো!

জন্ম-মৃত্যু, মহান আল­াহ তালার ইচ্ছা- ইশারায় হয়। কিন্তু ঘাতকদের সেচ্ছাচারিতায় এ নিরাপরাধ, নিস্পাপ ছেলেমেয়েগুলোর এখানে-সেখানে, পথে-ঘাটে মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। এ অরাজকতায় মহান আল­াহর আরশও কেঁপে উঠবে।

সন্তান হারানো মা-বাবার অশ্রুঝরা বুকফাটা চিৎকারে, বন্ধু হারানো বন্ধুদের আর্তনাদে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হারানোর বেদনায় হাজারো ছাত্র-ছাত্রীদের পথে নেমে এ অরাজকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে কি আমরা একাত্মতা প্রকাশ করতে পারি না! দু’তিন দিন কি আমরা এ ঘাতক বাসগুলোকে পরিহার করতে পারি না?

তবে কেন আন্দোলনরত এ শিক্ষার্থীদের পিঠে বেতের চপেটাঘাত! কেন তাদের পিছনে আমাদের পুলিশ ভাই-বন্ধুদের লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে! আন্দোলনরত এ শিক্ষার্থীদের ধরে ধরে কেন ঘরে ফেরার জন্য বাসে তুলে দেয়া হচ্ছে! তারা তো আর এ জাতীয় ঘাতক বাসে চড়তে চায় না। ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন ঘাতক চালক, বাচ্চা ছেলে-অপ্রাপ্তবয়স্ক ড্রাইভার বা হেলপারকে দিয়ে গাড়ি চালানো বা নেশায় বুঁদ হওয়া বা ঘুমন্ত ঘাতক চালকেরা যখন গাড়ি চালায় তা দেখার জন্য কি কেউ নেই?

আমরা সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে এসব কাজ করবো? এগুলো দেখার জন্য কি সরকার কাউকে নিয়োগ দেন নি?

বাধ্য হয়ে আজ আমরা সকল শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আন্দোলন করলে, গাড়ি জ্বালিয়ে দিলে, ভাংচুর করলে, নিরাপদ সড়ক চাই বলে চিৎকার করলে, প্রতিবাদ করলে, লাইসেন্স দেখতে চায়লে -আমাদের উপর, আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের উপর, আমাদের সন্তানদের উপর পুলিশের লাঠির চার্জ/বাড়ি খেতে হয়। গুলি, টিয়ারগ্যাস ছুঁড়ে আমাদের আন্দোলনের পথকে রুদ্ধ করা হয়! আমাদের সন্তানদের উপর ঘাতক ট্রাক-বাসের ড্রাইভার পুনরায় গাড়ি তুলে দিয়ে আমার সন্তানের বুক দুমড়ে মুছড়ে পিষে একাকার করে দেয়!!

কেন?

কেন?

ছিঃ ধিক্ শত ধিক্!!!

থুতু ছিটাচ্ছি নিজের গায়ে। জুতার বাড়ি দিচ্ছি নিজের গালে। আমাদের কি লজ্জা করে না, এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের প্রজন্মকে একটি দিনের জন্য পিছিয়ে দিতে! আমাদের লজ্জা করে না, এসব ভাঙ্গাচুরা গাড়িগুলোকে বিশ্ববাসীকে দেখাতে! আমাদের লজ্জা করে না, বিদেশীরা এদেশে এসে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে!

আমরা যে কিছুই করতে পারছি না তাই একে অপরকে মুখ দেখাতে পারছি না। আমরা কি এখনো সেই দৈনতায় আছি? আমরা তো উন্নয়নশীল বলে নিজেদের দাবী করছি।

তারা কি এতই শক্তিশালী যে প্রতিদিন আমাদের পিষে মারবে? ছি, ছি, ছি বিশ্ববাসীকে আমরা মুখ দেখাবো কিভাবে?
তাই আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসুরে বলতে চাই ——-

আমরা আর কোন তদন্ত চাইনা। একটা তদন্তের জন্য আরেকটা, আরেকটা তদন্ত করতে গিয়ে আরেকটা, আরেকটার জন্য আরেকটা, আরেকটা…..!!!!!!

আর চাইনা এসব প্রহসন।
এবার আমরা সরাসরি বিচার চাই।

যৌক্তিক দাবীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে কোন বাঁধা দেওয়া যাবে না। সাবধান, শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত দিবেন না!!!
আমাদের ছাত্ররা আমাদের প্রাণ।

আর এই প্রাণরা যখন জীবন দেওয়া শুরু করেছে তখন কিন্তু পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হতে শুরু করবে তা আমার সোনার বাংলার ইতিহাসেই লেখা আছে।

লেখক :

মাহবুবা সুলতানা শিউলি
সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।