আমাদের যুবসমাজ ও তাদের নৈতিক অধঃপতনের কারণ

আবদুল হাই ইদ্রিছী || বিশেষ প্রয়োজনে আমাকে রাজনগর যেতে হচ্ছে। হাতের কাজ রেখে অফিস থেকে বেরিয়ে দ্রুত মৌলভীবাজার শহরের চাঁদনীঘাটস্থ রাজনগরের সিএনজি স্ট্যান্ডে গেলাম। রিক্সা ছেড়ে একটি সিএনজিতে ওঠার জন্য যেয়ে দেখি, সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজির পিছনে সিটে একটি বোরকা পরা মেয়ে। সম্ভবত কলেজ ছাত্রী। মধ্যখানে আমার বয়সের সুঠাম দেহের অধিকারী একটা টগবগে যুবক এবং তার ডান পাশে আরেকটি তরুণ ছেলে বসা। সামনের সিটে চালকের বাম পাশে একজন মধ্যম বয়সী লোক বসে পান চিবাচ্ছেন। চালক আরো একজন যাত্রীর জন্য বসে অপেক্ষা করছেন। যদিও একটি সিএনজিতে ৩ জনের বেশী যাত্রী নিয়ে চলা নিষেধ, তবুও আমাদের দেশে ৫ জনের কম যাত্রী হলে চালকরা গাড়ি ছেড়ে যান না। কখনো বা ৬/৭ জন পর্যন্ত নিয়ে চলতে দেখা যায়। এসব অনিয়ম দেখবে কে? কারণ- যেখানে আইন টাকার হাতে জিম্মি, সেখানে- আইনের কথা বলে আর লাভ কী? দেশের শতকরা ৮০ ভাগ গাড়ি এবং গাড়ি চালকের লাইসেন্সই নেই তবুও তারা দম্ভ করে চলেন। ডেট অভার লক্কর-ঝক্কর গাড়ি ও লাইসেন্সহীন অদক্ষ চালকদের কারণে প্রতিদিন রাস্তায় কত তরতাজা প্রাণ ঝরে পড়ছে! খালি হচ্ছে কত মায়ের বুক! বিধবা হচ্ছেন কত নারী! এতিম হচ্ছে কত শিশু, কিন্তু সঠিক বিচার কি কোথাও হচ্ছে? বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে, শুধু ২০১৮ সালে দেশে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ৭ হাজার ২২১ জন নিহত হয়। আহত ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯)

সিএনজির পাশে গিয়ে যখন ইতস্ততবোধ করছিলাম, এই গাড়ির সামনে সিটে বসেই যাবো না কি অপেক্ষা করে পরের গাড়িতে যাবো। এই সময় সিএনজিটির পেছনে সর্ব ডানে বসে থাকা তরুণ আমাকে তাঁর সিটটি দিয়ে সে সামনে চলে আসলো। গাড়ি চলছে। আমি বসে বসে মোবাইলে ফেসবুক দেখছি। কিছু পথ যাবার পর গাড়িতে বসে থাকা মেয়েটি মধ্যখানে বসে থাকা ছেলেটিকে ঝাড়ি দিয়ে কি জানি বললো! মেয়েটির কথা স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও ছেলেটি যে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ‘সরি’ বলেছে তা স্পষ্টই বুঝা গিয়েছে। গাড়ি চলছে। কেউ আর কোন কথা বলছে না। আমি মোবাইল বন্ধ করে বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। গাড়ি আরো প্রায় ২ কি.মি. যাবার পর আবার মেয়েটি উচ্চ কন্ঠে ছেলেটিকে বললো, এই মিয়া হাত সরান। বেয়াদব। চালককে লক্ষ্য করে বললো, ড্রাইভার গাড়ি থামাও! চালক গাড়ি থামালে মেয়েটি চট্ করে গাড়ি থেকে নেমে- ‘আমি আর এই গাড়িতে করে যাবো না’ বলে বড় বড় চোখ বের করে ছেলেটির দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আর ছেলেটি নীচের দিকে তাকিয়ে মোবাইল টিপছিলো। নির্বাক সবাই। এর মধ্যে গাড়ির সামনে চালকের ডান পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক বললেন কী হয়েছে? মেয়েটি কোন জবাব দিচ্ছে না। ভদ্রলোক আবার বললেন ঠিক আছে এখানে বসতে সমস্যা হলে আপনি গাড়ির ওই পাশে চলে যান। কয়েক সেকেন্ড পর মেয়েটি গাড়ির পেছন দিয়ে ঘুরে ডান দিকে আসলো। আমি বাম দিকে চেপে মেয়েটিকে বসার সুযোগ করে দিলাম। গাড়ি চললো। রাজনগরে পৌঁছার বেশ আগেই মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমে চালককে ভাড়া দিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে- ‘বেয়াদব, তোর কি বাড়িতে মা-বোন নেই!’ বলে চলে গেলো। ছেলেটি কোন কথা বললো না। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। আরো কিছু দূর গিয়ে ছেলেটিও গাড়ি থেকে নেমে গেলো। যদিও আমরা প্রকাশ্যে কিছু দেখিনি তবুও বুঝতে বাকি রইলো না এখনে কী হচ্ছিলো? এই হচ্ছে আমাদের যুব সমাজের মানসিক অবস্থা! আমাদের চোখের আড়ালে এই রকম ঘটনা তো প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ অহরহ ঘটছে! এসব ঘটনার জের ধরে ধ্বংস হচ্ছে কত মেয়ের জীবন। ঝরে যাচ্ছে কত তরতাজা প্রাণ! কিন্তু কেন এমন অধঃপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে আমাদের যুব সমাজ তা কি আমরা একবারও ভেবে দেখছি? আমরা কি একবারও চিন্তা করছি তাদেরকে সৎ এবং যোগ্য হিসাবে কী করে গড়ে তুলতে পারি?

শিশুরা মাতা-পিতা থেকে যেরকম নৈতিক এবং ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করে, সে শিক্ষা নিয়েই তারা বড় হতে থাকে এবং সে শিক্ষা জীবন তাদের চলার পথের পাথেয় স্বরূপ। ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব নৈতিক অবক্ষয়ের জন্ম দেয়। কারণ ধর্মই মানুষকে নৈতিকতা শিখায়। সব ধর্মেই এই শিক্ষা রয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ যাদের অন্তরে থাকবে তারা কখনো বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করতে পারে না। এর জন্য পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’টিই দায়ী। পরিবারের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। শুধু টাকা-পয়সা দিয়ে সন্তানকে মানুষ করা যায় না। সন্তানকে আপত্য স্নেহ ভালোবাসা দিতে হয়। সন্তানকে সময় দিতে হয়। তাকে নৈতিকতা অর্জনের পথে চলার জন্য বুঝাতে হয়, উদ্বুদ্ধ করতে হয়। পিতা-মাতার যত রকম ইনভেস্ট আছে সবকিছুর ওপরে বড় ইনভেস্ট হচ্ছে তার সন্তান। সন্তানই জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এটা সবাইকে বুঝতে হবে এবং মানতে হবে। পরিবার হচ্ছে এখানে মূল বিষয়। নিয়ন্ত্রণ পরিবার থেকেই করতে হবে। প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলারদের মন্তব্য-এটা সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ পরিণতি। সমাজ থেকে আদর্শিক তথা ধর্মীয় মূল্যবোধ একেবারেই চলে গেছে। আকাশ সংস্কৃতি, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের অবাধ ব্যবহার, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা আমাদের তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রটেকশন ওয়াল হিসেবে কাজ করার কথা ছিল সেই শিক্ষা তো এখন নেই। ফলে নৈতিক অবক্ষয় মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। আল্লাহ পাকের ঘোষণা- “তোমরাই মানবম-লীর জন্য শ্রেষ্ঠতম উম্মাতরূপে আবির্ভূত হয়েছো, তোমরা ভাল কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজের নিষেধ করবে”। (সূরা আল -ইমরান, আয়াত : ১১০)।

বর্তমান সময়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে অধিকাংশ যুবকের নৈতিক অবক্ষয় ও পতন দেখা যাচ্ছে। কারণ, তারা নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে পশ্চিমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনুকরণে ব্যস্ত । পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ঘেরাটোপে যুব সমাজ এক ধরণের আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে পোশাক-আশাক, চলা-ফেরা সহ যাবতীয় বিষয়ে পশ্চিমাদের অনুকরণ করছে। যুব সমাজকে ধ্বংসের উপকরণ অসংখ্য ও অগণিত। যেমন, মোবাইল, কম্পিউটার, রেডিও, টেলিভিশন, নগ্ন ম্যাগাজিন ইত্যাদি। এগুলো যুব সমাজকে ধ্বংস করা ও তাদের চরিত্রকে হরণ করার জন্য খুবই ক্ষতিকর ও বিষাক্ত মাধ্যম। যদিও আমরা জানি প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আধুনিকতার ছোঁয়ায় এগুলি আমাদের জন্য একদিকে আশীর্বাদ কিন্তু অন্যদিকে অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। যুবকরা নিজেদের ক্ষতিকর দিকসমূহ বুঝতে না পেরে এ সবের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। যুব সমাজ যদি এ সব ক্ষতিকর উপসর্গ থেকে নিজেকে রক্ষা করে তাহলে নিজেদের কল্যাণকে নিশ্চিত করবে। কারণ, এসবের পরিণতি খুবই মারাত্মক ও ক্ষতিকর। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতি বিদ্যমান। সংস্কৃতি মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু বর্তমান সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যুগে সুস্থ ও নির্মল সংস্কৃতি বিলুপ্ত হওয়ার পথে। অপসংস্কৃতির ছোঁয়ায় সুস্থ সংস্কৃতির ধারা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। অপসংস্কৃতির কারণে জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে হাজার বছর এগিয়ে গিয়েও ধ্বংস-উন্মুখ সভ্যতায় পরিনত হতে চলেছে উন্নত দেশগুলো। ফলে খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং, আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি ও অপরাধ সংস্কৃতি তাদের জীবনকে বিষাক্ত করে তুলেছে।

যত দিন যাচ্ছে ততই সমাজের অঃধপতন হচ্ছে। বাড়ছে অশান্তি। যুব সমাজ হচ্ছে জাতির হৃদপি-। সমাজে যুবকরা যখন তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে, সৎ ও ভাল কর্ম করবে, তারা তাদের মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে অবগত হবে এবং তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে, তখনই দেশে শান্তি আসবে এবং দেশ ও জাতি বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

লেখক : আবদুল হাই ইদ্রিছী, কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। সম্পাদক: মাসিক শব্দচর।