‘আমার নাম মোহাম্মাদ, আমি এক রোহিঙ্গা’

মোহাম্মদ সোয়ে, বয়স ৩৩। রাখাইন রাজ্যের বুথিডং শহরের বাসিন্দা। ১০ দিন আগে তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। তার মতো হাজারে হাজার মানুষ প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। ‘আমার নাম মোহাম্মদ, আমি এক রোহিঙ্গা’ শীর্ষক লেখায় মোহাম্মদ যেন নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের জীবন্ত প্রতিনিধি।

মোহাম্মদের জবানিতে শুনুন, কী কারণে তারা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছে-

অন্যান্য রোহিঙ্গাদের মতো বুথিডং শহরের কৃষক ছিলাম আমি। আমাদের কাজের অধিকার নেই, নেই শিক্ষার অধিকার, যার বদৌলতে আমরা পুলিশ, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য ভালো চাকরি লাভের সুযোগ পেতে পারি। আমাদের খেতে কাজ করতে হয় অথবা বনজঙ্গল থেকে বাঁশ জোগাড় করতে হয়।

আমাদের অবস্থা ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ গোছের। যেকোনোভাবে আমরা বেঁচে থাকলেও আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। আমরা সবাই শুধু কোনোমতে জীবন ধারণ করে চলেছি।

দুই সপ্তাহ আগে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধরা আমাদের গ্রামে ঢুকে গেল। একে একে আমাদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করল, বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে লাগল। আমার ভাইয়ের মুখে গুলি লাগল এবং সে মারা গেল। আমরা দৌড়ে পালিয়ে গেলাম, না হলে আমাদেরও মরতে হতো।

আমরা জানতাম না, আমারা কোথায় যাব। আমরা ১০ দিন ধরে হাঁটার পর বাংলাদেশে এসে পৌঁছালাম।

আমার মায়ের বয়স ৮০ বছর, তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং শ্বাসকষ্টের রোগী। যে কারণে পুরোটা পথ তাকে বয়ে আনতে হয়েছে আমাকে। তিনটি নদী নৌকায় পার হয়ে এবং বাকি পথ হেঁটে এসেছি আমরা। কখনো কখনো আমরা সেনাবাহিনীর কাছে চলে এসেছি, তারা আমাদের ওপর গুলি চালাতে পারত। কখনো কখনো আমরা বনেজঙ্গলে ঘুমিয়ে পড়েছি, যেখানে অনেক বন্য জন্তুজানোয়ার রয়েছে।

পথে অনেক বাধা ছিল। কিন্তু বাঁচার চেষ্টা আমাদের চলতে সাহায্য করেছে এবং শেষ পর্যন্ত আমরা সীমান্ত পার হয়েছি। বাংলাদেশে আসতে পেরে আমি এখন অনেক ভালো বোধ করছি। বাড়ি ফিরে গেলে যেকোনো সময় আমাদের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু এখানে আমাদের জীবন নিরাপদ।

কিন্তু এখনো বাংলাদেশ আমাদের জন্য পুরোটাই অজানা। এ দেশ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আমরা অশিক্ষিত। এখানে আমাদের কী করতে হবে, তাও জানি না। যদি শান্তি ফিরে আসে, তাহলে আমরা বাড়িই ফিরে যাব, যেখানে সবকিছু আমাদের চেনাজানা।

আমি জানি, সারা বিশ্ব এই রোহিঙ্গা সংকটের চিত্র দেখছে। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে যে সহিংসতা চালানো হচ্ছে, তা বন্ধে এখনো কাউকে মিয়ানমার সরকারকে চাপ দিতে দেখিনি। তারা এর সমাধান চাচ্ছে না, নাহলে আমরা তার আমালত দেখতাম। কিন্তু জানি না, কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে না।

বিশ্ববাসীর কাছে আমার নিবেদন হলো- সব মানুষই সমান। শুধু ধর্ম আমাদের আলাদা করে রাখতে পারে না। আমাদের মতো বৌদ্ধদেরও রক্ত-মাংস আছে। তারা যদি মিয়ানমারে শান্তিতে বসবাস করতে পারে, তাহলে আমরা কেন নয়? আমরা তো সবাই মানুষ এবং মানুষ হিসেবেই সবাই জন্মগ্রহণ করেছি।

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের নতুন রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির উঁচি প্রাঙ্ক-এ মোহাম্মদ সোয়ের সঙ্গে কথা হয় আলজাজিরার কাটি আরনল্ডের। তার কথাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। শনিবার আলজাজিরায় এটি প্রকাশ করা হয়েছে। ভাষার শুদ্ধতার জন্য তার কথাগুলো কিছুটা পরিমার্জন করেছে আলজাজিরা।