আমির মিয়ার দাক্ষিণ্যসঞ্চয় || সালেহ খান বাবলু

আমির মিয়ার মনটা আজ বেজায় ভালো।
অবশ্য প্রতিদিন সন্ধ্যায়ই তার মন ভালো থাকে। সারাদিন কর্মশেষে কর্মফল হিসাব করে সন্ধ্যায়। কর্মফলও মোটামুটি ভালো পাচ্ছে। তাই ইদানীং তার সন্ধ্যাগুলো ’শুভ সন্ধ্যা’ হয়ে আসছে!

প্রতিদিনের চেয়ে আজ একটু বেশিই কামাই হয়েছে আমির মিয়ার। মন বেশি ভালো থাকার কারণ এটাই। আমির মিয়া হাতে ছ্যাপ মেখে গুণে গুণে দেখল তার থলেতে ৯৩৭ টাকা পড়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই পরিমাণ কামাই— ভীষণ ব্যাপার। তার উপর দুপুরের খাওয়াটাও হলো মাগনা মাগনা।

আমির মিয়া ভিক্ষাবৃত্তি করে। সে অবশ্য ’ভিক্ষাবৃত্তি’ বলে না, মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। সে এটাকে নাম দিয়েছে ’দাক্ষিণ্যসঞ্চয়’। ভিক্ষার দাক্ষিণ্য প্রতিশব্দটা অভিধান ঘেঁটে বের করেছে। ভিক্ষার জায়গায় ’দাক্ষিণ্য’ আর বৃত্তির বদলে ’সঞ্চয়’ শব্দটা লাগালে নাকি সেটাও ব্যবসার মতো সম্মানিত রোজগার হয়ে যায়। ভিক্ষাবৃত্তিটা নিম্নশ্রেণির হতে পারে, তবে আয়-রোজগার কিন্তু মোটেও কম নয়।

আমির মিয়া আগে মানুষের বাড়িতে কামলা খাটত। ভগ্ন শরীর নিয়ে সারাদিন গাধার মতো খেটে পাঁচশ টাকা রোজ পেত। এতে তার পুষে না। তাই অনেক ভেবেচিন্তে, অনেক বুদ্ধি ব্যয় করে সে এই ’দাক্ষিণ্যসঞ্চয়ে’র বন্দোবস্ত করল। আবার এই কর্মটির জন্য যুৎসই জায়গার প্রয়োজন, যেখানে লোকসমাগম থাকে। তাই গৌরীপুর রেলওয়ে স্টেশনটাকে তার কর্মকেন্দ্র বানাল। তার ধারণা, রেলপথের যাত্রীরা বেশ সহানুভূতিশীল হয়— তাই দাক্ষিণ্যসঞ্চয়টা খুব সহজেই চাঙা করে তোলা যায় এখানে।

দাক্ষিণ্যসঞ্চয় করতে গিয়ে আমির উদ্দিনের বেবাক অভিনয় করতে হয়। অভিনয়ে সে দারুণ পটু। অভিনব সব অভিনয় নিত্যসময় তার মাথায় ঘোরপাক খায়। অভিনয় করতে গিয়ে সে কখনো ঠ্যাং মুড়ে লুলা হয়, কখনো শরীরের কোনো অংশ কাঁপাতে কাঁপাতে মৃগীরোগী সাজে, কখনো চোখের পাতা উল্টিয়ে কালো চশমা লাগিয়ে কানা হয়ে যায়। তার নিঁখুত কর্মযজ্ঞে মানুষ নিজের অজান্তেই দয়াপরবশ হয়ে পড়ে।

আমির মিয়া আজ কানার বেশ ধরেছিল। তার জীর্ণশীর্ণ কাপড়, কৃশ দেহ, ভাঙাচোড়া চোয়াল, ভগ্ন মুখাবয়ব, আর চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমায় ভিক্ষুকবেশটা দারুণ মানিয়েছিল। তার উপর আজ ভৈরভ লাইনে গিয়েছে। আমির মিয়া খেয়াল করেছে যে, ভৈরভ লাইনে কামাইটা বেশি হয়।

ঈশা খাঁ এক্সপ্রেসে আজ প্রচুর ভীড় ছিল। ভীড়ের মধ্যেই এসব কর্ম জমে ওঠে। আজও তাই হলো। তাকে যেই দেখছে দয়াদাক্ষিণ্য করছে। আবার কেউ কেউ নাকও ছিটকাচ্ছে। আসলে বাঙালি জাতি যেমন দয়াপরবশ, তেমনি নিষ্ঠুর। আমির মিয়া কারো অবজ্ঞা গায়ে না মেখে মিহি গলায় গেয়ে যাচ্ছে— আমার আল্লাহ নবীজীর নাম….।

আজকের কামাইয়ের বড় একটা অংশ ছিল ভৈরব জামে মসজিদ। জুমার নামাজের পর মসজিদের দরজায় ভালো একটা জায়গা পেয়েছিল সে। অবশ্য জায়গাটা পেতে তার বেশ বেগ পেতে হয়েছে। এক ভিক্ষুকের সঙ্গে তো রীতিমত মারামারিই বেঁধেছিল। তখন মুসল্লিরা এসে থামায়।

আমির মিয়া যখন মসজিদের দরজায় বসে গজলের টান দিল তখন তার থলেতে পাতার মতো টাকা পড়ছিল। বড়ই মুগ্ধকর দৃশ্য। কোনো মুগ্ধকর দৃশ্যই স্থায়ী হয় না— এটাও হলো না। অবশ্য যা হয়েছে তা দেখেই প্রতিবেশি ভিক্ষুকরা ঈর্ষায় জ্বলছিল। একপর্যায়ে তো টাকা নিয়ে কাড়াকাড়িই শুরু হয়েছিল! আমির মিয়া তখন নিজেকে সংযত করে কেটে পড়ল। কারণ ভিক্ষাবৃত্তিতে সে নতুন, তাই ঝগড়া বাঁধাতে তার লজ্জা লাগে। খুব লজ্জা। তার ধারণা অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এই লজ্জা কেটে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তখন সে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ ভিক্ষুক হতে পারবে। যেকোনো কাজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারা সৌভাগ্যের ব্যাপার, হোক না সেটা ভিক্ষাবৃত্তির ক্ষেত্রেও।

আমির মিয়া ভৈরব স্টেশনে বসে এসব সাতপাঁচ ভাবছে। তার নিচে একটা ভাঁজ করা ত্রিপল। ত্রিপলের উপর বসে যুৎ পাচ্ছে না। নিচে একটা সোফার হোম হলে মন্দ হত না!

আজ আকাশটা স্বচ্ছ। নীলাভ। তাই স্টেশনে প্রচুর লোকসমাগম। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ময়মনসিংহগামী বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস এইমাত্র ভৈরব স্টেশনে থামল। যাত্রীদের উপচেপড়া ভীড়। এর মধ্যে কালো স্যুটপরা এক ভদ্রলোক তার দিকে এগিয়ে এলো। আমির মিয়া তাকে দেখে উচ্চস্বরে গানটা ধরল— দান করিলে মান বাড়ে ভাই…।
সঙ্গে সঙ্গে তার কানা ভঙ্গিটা আরো গাম্ভীর্যভাবে ফুটিয়ে তুলল। কারণ অল্প সময়ের মধ্যেই ৬৩ টাকা কামাই করে একহাজার টাকা পরিপূর্ণ করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

কালো স্যুটপরা লোকটা বলল,
’একহাজার টাকা ভাংতি হবে?’
’কত দিবেন স্যার?’
’দশ টাকা।’
’স্যার কি দান করবেন, নাকি টাকা ভাঙাতে আইসেন?’

আমির মিয়ার জবাব শুনেন লোকটা কুণ্ঠিত হলো। আর তাতে আমির মিয়ার ভালো লাগে। কিছু কিছু মানুষ টাকা ভাঙাতে, ছিঁড়া টাকা চালাতে দান-খয়রাত করে। এইসব লোকদের এমন মোক্ষম প্রশ্ন ছোঁড়াই উচিত। লোকটাকে এমন ঘায়েল করে আমির মিয়া নিজেকে বড়ই চালাক মনে করল। চালাক মানুষরা অন্যকে ঠকিয়ে খুব আনন্দ পায়।

লোকটা বলল,
’এইখান থেকে ৫০ টাকা রাখ্।’
’আমার কাছে মোটমাট ৯৩৭ টাকা আছে। ৬৩ টাকা দান করলে কন।’

লোকটা ইতস্তত করে একহাজার টাকার একটা নোট বার করল। আজ যেহেতু আমির মিয়া কানা, তাই সেটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য পাশে একটা লোককে বলল, ভাইজান এটা কি একহাজার টেইক্যা নোট?

আমির মিয়া খুশিতে গদগদ হয়ে টাকা পকেটে পুরল। খুচরা টাকার ঝামেলা চুকিয়ে নিজেকে হালকা লাগছে বেশ।

প্রচণ্ড আনন্দে মানুষ খিদের কথা ভুলে যায়। কিন্তু আমির মিয়ার হলো উল্টোটা। তার প্রচণ্ড রকমের খিদে পেয়েছে। মোটা দাগের একটা কামাই করতে পেরে সে নিয়ত করল আজ হোটেলে গরুর গোশত দিয়ে ভাত খাবে। কতদিন গরুর মাংশ খাওয়া হয় না।
তাছাড়া কামাই করে শোকরিয়ার একটা ব্যাপার আছে। আল্লাহ পাক কোরআনে বলেছেন— শোকরিয়া আদায় করলে নিয়ামত বৃদ্ধি পায়, না করলে হ্রাস পায়।

আমির মিয়া গরুর গোশত দিয়ে ভাত খেল। পেটপুরে। ’শালা-দুলাভাই হোটেলে’র মাংশটা ভালোভাবে সিদ্ধ হয়নি। মালিককে ঠেলা দেয়া দরকার। আর হোটেলের নাম কেন ’শালা-দুলাভাই’ তাও জানা দরকার!

আমির মিয়ার বিল আসল ১৪০ টাকা। অন্যদিন হলে ভাতের দর এত কেন, গোশতের দাম আরেকটু কম হলে ভালো হত না— এসব কথা শোনাত। আজ তা করল না। মানুষের যখন টাকা বেশি থাকে, তখন ব্যয়ের উৎস নিয়ে মাথা ঘামায় না।

পকেট থেকে চকচকে নোটটা বের করে দিল আমির মিয়া। হোটেলের মালিক নোটটা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখেই বলল, কোত্থেকে আনছেন এই নোট?
আমির মিয়া অবাক হয়ে নোটটা হাতে নিল। নোটটা উপরে তুলে ধরে দেখল মাঝখানে ’গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ লিখিত ফিতাটা নেই। এই লিপিবদ্ধ ফিতাটা প্রমাণ করে নোটটা জাল নাকি আসল।
আমির মিয়া জলদি করে সেই স্যুটপরা মানুষটাকে খোঁজ করার উদ্যত হলো। ঠিক তখন হোটেলের বেয়ারা তাকে ধরল— বিল না দিলে কোনোভাবেই ছাড়বে না!

আমির মিয়া এখন হোটেলে বাঁধা। কীভাবে ছাড়া পাবে বুঝতে পারছে না। তবে সে প্রতিজ্ঞা করল, আর কখনো ভিক্ষা করবে না। করলেও অন্তত কানা সাজবে না।