আরব সংকট : দড়ির ওপর হাঁটছে বাংলাদেশ

ফারুক ওয়াসিফ : কাতার ঘিরে নতুন সংকটে কোনো পক্ষে ঝুঁকে পড়ার দীর্ঘমেয়াদি মাশুল আছে। বাংলাদেশকে একবার তাকাতে হচ্ছে গতানুগতিক ‘ঘনিষ্ঠ’দের সঙ্গে গতানুগতিক ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখার দিকে, আবার ভাবতে হচ্ছে দেশের প্রধান শ্রমবাজার অটুট রাখার কথাও। অবস্থাটা অনেকটা শ্যাম রাখি না কুল রাখি। বাংলাদেশকে হাঁটতে হচ্ছে দড়ির ওপর দিয়ে। কাতারকে একঘরে করায় সৌদি আরবের পদক্ষেপ ভাতে-পানিতে তথা রুটি-মাংসে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে বেশি দূর গড়ায় কি না, সরকারি ভাষায় তা ‘গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ’ করছে বাংলাদেশ। প্রবাসী আয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক আয়ের খাত। এই খাতে সম্প্রতি যখন মন্দা চলছে, তখন রেমিট্যান্সের উৎসে উত্তেজনা অর্থনীতির জন্যও চিন্তার বিষয়। এ অবস্থায় দেশীয় বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের আগ্রহ ভারসাম্যের দিকে।

কাতার পরিস্থিত দ্রুত ঘনীভূত হচ্ছে। ইরান ও তুরস্ক দেশটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ইরানের বন্দরগুলো কাতারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণার পরপরই সে দেশের জাতীয় দুই প্রতীকে প্রাণঘাতী হামলা হয়। ইরানের পার্লামেন্ট ও ইমাম খোমেনির মাজারে এই হামলার দায় আইএস নিলেও, ইরানের অভিযোগ সৌদি আরবের দিকে। যে নামেই ঘটনা ঘটানো হোক, তা অবশ্যই বুমেরাং হয়েছে। ইরান ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে যখন যুক্তরাষ্ট্রসহ সৌদি নেতৃত্বাধীন দেশ আইএস-এর সঙ্গে এক পাল্লায় রাখা হচ্ছে, তখন ইরান পাল্টাভাবে বলতে পারছে, দেখো, যারা আমাকে সন্ত্রাসী বলছে, তাদের লোকই আমার দেশে সন্ত্রাসী হামলা ঘটাচ্ছে।

আজ বৃহস্পতিবার তুরস্কের পার্লামেন্টে কাতারের ঘাঁটিতে সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত পাস হয়েছে। যদিও তুরস্ক বলছে, আমরা কাতারের পক্ষে হলেও সৌদি আরবের বিপক্ষে নই। রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক-সিরিয়ার মধ্যে যে কৌশলগত সম্পর্ক স্পষ্ট হচ্ছে, কাতার দাঁড়িয়ে আছে তার মোহনায়। সৌদি চাপের কাছে কাতারের মেরুদণ্ড না-বাঁকানোর অর্থ দেশটির রাশিয়া-ইরান অক্ষের দিকে ঝুঁকে পড়া। তা ঘটলে কাতারের পরিণতি ইরাকের মতো না হলেও, কাতারের আমীরকে মিসরের মোহাম্মদ মুরসির পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। সৌদি-ইসরায়েলি পক্ষের বাইরে থাকার শাস্তি হিসেবে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দী হতে হয়। কাতারের আমিরকে সেকথা মনে করিয়ে দিলেন সৌদি রাজপরিবারের সদস্য এবং সৌদি-আমেরিকান পাবলিক রিলেশন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রেসিডেন্ট সালমান আল-আনসারি। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘কাতারের আমিরকে বলছি… আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, মোহাম্মদ মুরসি আপনার মতোই করেছিল এবং তারপর তাঁকে উচ্ছেদ করে বন্দী করা হয়েছিল।’ এ ধরনের হুমকি সামলে যেভাবে টিকে আছেন সিরিয়ার বাশার আল আসাদ, সেভাবে টিকে যেতে পারে কাতারের শাসকগোষ্ঠী। অথবা তাঁকে ফিরতে হবে মার্কিন-ইসরায়েল-সৌদি বলয়ে।

আকষ্মিক এ অস্থিতশীলতায় মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক প্রেরণকারী সব দেশই উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ যেমন বাংলাদেশের, তেমনি ভারত-নেপাল-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনেরও। উপসাগরীয় দেশগুলির শ্রমবাহিনী মূলত দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিকদের নিয়েই গঠিত। তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে কাতারের রয়েছে বিরাট আকারের বাণিজ্য সম্পর্ক। কাতার ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির অন্যতম বিনিয়োগকারী অংশীদার। বাংলাদেশেও কাতারের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য রয়েছে। আপন স্বার্থেই ভারতসহ উপমহাদেশীয় সরকারগুলো চাইবে না মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান স্থিতাবস্থা বদলে যাক। তেলের দাম বেড়ে গেলে সৌদি আরবসহ রপ্তানিকারক দেশের লাভ হলেও বাংলাদেশের মতো আমদানিকারক দেশের ক্ষতি। আরবের রাজায় রাজায় এ বিরোধে তাই উলুখাগড়াসম বাংলাদেশিদের সমূহ ক্ষতির ভয়। এই ভয় মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী শ্রমিক, বিশেষ করে কাতারে অবস্থানকারী বাংলাদেশি এবং দেশে তাঁদের পরিবারের মধ্যে ব্যাপক।

বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন তাই মনে করেন, ‘দুই পক্ষেই আমাদের স্বার্থ রয়েছে। এক পক্ষে গিয়ে অন্য পক্ষের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া আমাদের পোষাবে না। বিষয়টা তো কেবল সৌদি আরব আর কাতারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বাহরাইন, আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান এবং মিসরেও বাংলাদেশি কর্মীরা কাজ করছেন। কাতারে আমাদের শ্রমিকেরা ভালো মজুরিও পেয়ে থাকেন।’

মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে কাতারের অর্থনীতি বেশি শক্তিশালী এবং দেশটি ২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক। বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রের মালিকানা দেশটির অর্থনীতিকে প্রসারিত করছে। আগামী দিনে কাতারেই শ্রমিক প্রেরণের সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করেন তৌহিদ হোসেন। হাল আমলে তুলনামূলকভাবে কাতারই বাংলাদেশ থেকে বেশি শ্রমিক নিচ্ছে। বেসরকারি হিসাবে প্রতি মাসেই ১০ থেকে ১২ হাজার বাংলাদেশি কর্মী কাতারে যাচ্ছেন। সরকারের তরফে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানের অভাবের কথা উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘সৌদি আরবে বর্তমানে ১৫-২০ লাখ এবং কাতারে ৩ লাখের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই সৌদি-আমেরিকান চাপের কাছে বাংলাদেশকে সময়ক্ষেপণের কৌশল নিতে হবে। আরবের এই সংকট হয়তো একসময় মিটে যাবে, কিন্তু চাপের মুখে বিপক্ষতার কথা কাতার ভুলবে না।’ দৃঢ়ভাবে মধ্যপন্থা অবলম্বনের পরামর্শ দেন তিনি।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চেয়ে বর্তমান অবস্থা ভিন্ন বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিম উদ্দিন খান। তাঁর ভাষায়, ‘ওবামার সময় বাংলাদেশ সরকারের কোনো কোনো মুখপাত্র যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কথাবার্তা বলে গেলেও, ট্রাম্প প্রশাসন তেমন আচরণ সহজভাবে নেবে না। সৌদি-ইসরায়েল অক্ষের মধ্যে কাতারকে ধরে রাখাই হলো মার্কিন স্বার্থ। তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশও সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের সদস্য হয়েছে। কাতার এই জোটের সদস্য হয়েও ভিন্নমত ধারণ করছে বলেই সংকটের উৎপত্তি।’

ড. তানজিম আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দেন, ‘কাতারে শুধু আমাদের শ্রমিকের স্বার্থই নেই, সম্প্রতি কাতার বাংলাদেশ ব্যাংকে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গচ্ছিত রাখার চুক্তি করেছে। প্রয়োজন পড়লে তেল কেনার জন্য এখান থেকে আমরা ঋণ নিতে পারব’। উল্লেখ্য, এলএনজি গ্যাস আমদানিতে কাতারের ওপর বাংলাদেশ নির্ভরশীল।

সৌদি-কাতার বিভেদকে কেবল মতবিরোধ বলে মনে করেন না ইস্ট এশিয়া স্টাডি সেন্টারের পরিচালক ড. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর অর্থনীতি পরস্পর-সম্পর্কিত। এ অঞ্চলের কোনো দেশের স্থিতিশীলতায় ধাক্কা লাগলে তার প্রভাব অন্য দেশেও পড়বে। আবার এই পুরো অঞ্চল তথা এর অর্থনীতি বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কাতারে প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিক যাচ্ছিল। উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়ায় তা থমকে গেছে। আমাদের প্রবাসীরা এই পরিস্থিতির উত্তাপ অনুভব করছেন’।

ড. দেলোয়ারের পরামর্শ, ‘বাংলাদেশ যেহেতু নিরপেক্ষতার কূটনীতি বহুকাল ধরেই অনুসরণ করে আসছে, সেটাই ধরে রাখা উচিত। মৌরিতানিয়া বা মালদ্বীপের মতো দেশ চাপে পড়ে কাতারের বিপক্ষতা করছে, আমাদের সে সুযোগ নেই। আরব লিগ কিংবা ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) ফোরামে বহুপক্ষীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় আমরা থাকতে পারি। কিন্তু দ্বিপক্ষীয়তার মধ্যে আমাদের ঢোকা ঠিক হবে না।’ অতীতে বাংলাদেশের সব সরকারই সব আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্কের নীতি অনুসরণ করে এসেছে। বাংলাদেশকে সেই ধারাবাহিকতাই বিচক্ষণতার সঙ্গে আঁকড়ে থাকার অভিমত দিয়ে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস ইস্যুতে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি। তার অর্থ এই নয় যে দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্রনীতি আমরা বদলে ফেলব।’

দৃশ্যত সৌদি আরব ও মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। ইরান ও ফিলিস্তিন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের সম্মিলিত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কাতার একমত নয়। গত সপ্তাহেই ইসরায়েল ৩৬ ঘণ্টার সামরিক মহড়া চালিয়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এর লক্ষ্য ফিলিস্তিন ও লেবাননে নতুন সামরিক অভিযান। এ প্রেক্ষাপটে কাতারকে একঘরে করে ইরানকে বন্ধুহীন করার আয়োজন কতটা সফল হবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তবে সৌদি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী সামরিক জোট কথা থেকে কাজে নেমে পড়লে বাংলাদেশের নিরপেক্ষতার নীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কেননা কাতারকে বর্জনকারী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশও এই জোটের সদস্য। ওয়াশিংটন ইরানের বিরুদ্ধে আরব-ন্যাটো জোটে ইসরায়েলকে ঢোকাবার চেষ্টার অংশ কাতারকে একঘরে করা, বলছেন মধ্যএশিয়া বিষয়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক পেপে এসকোবার। তা ঘটতে চললে, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক উভয় দিকেই সংকটে পড়বে বাংলাদেশ।

এ যাবৎকালে বাংলাদেশের সরকার এবং জনমত সময়ে-সময়ে ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এসেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহাসিক অভিপ্রায়ও বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একটি অংশ।মতামত কলামটি প্রথম আলো’র সৌজন্যে প্রকাশিত।