আরসা কি আল-কায়েদার শাখা?

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের তথাকথিত সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি’ (আরসা) নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে।

প্রশ্ন উঠেছে, আরসা কি আল-কায়েদা বা অন্য কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের শাখা? কেনইবা এটি গড়ে উঠল অথবা তাদের কাজ কী? তাদের কার্যক্রম পরিচালনার অর্থ আসে কোথা থেকে?

এক বিশেষ প্রতিবেদনে এসবের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে আলজাজিরা। প্রতিবেদন তৈরি করেছেন ফয়সাল এদরুস।

আরসা কারা?
আরসার আগের নাম ছিল হরকাতুল ইয়াকিন। রাখাইন রাজ্যের মংডু ও রাথেডংয়ে পুলিশ আউটপোস্টে হামলার মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে তারা। ওই হামলায় মিয়ানমারের নয় পুলিশ সদস্য নিহত হন।

১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর থেকে নানাভাবে রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হয়ে এলেও তাদের হাত ধরে কোনো সহিংসতা সৃষ্টি হয়নি। কোনো ধরনের সশস্ত্র বিদ্রোহ বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনও গড়ে ওঠেনি। তাহলে আরসা এল কোথা থেকে, তাদের কাছে কি অস্ত্র আছে?

মিয়ানমারের স্থানীয় রোহিঙ্গারা আলজাজিরাকে জানিয়েছেন, গত বছর আরসার মাত্র কয়েকজন সদস্য লাঠি ও ছুরি নিয়ে পুলিশের আউটপোস্টে হামলা চালায়। পুলিশ সদস্যদের হত্যার পর তাদের কাছ থেকে কিছু হালকা অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।

গত বছর অক্টোবর মাসে আরসার নেতা আতাউল্লাহ আবু আমর জুনুনি হামলার পক্ষে সাফাই বক্তব্য হিসেবে ১৮ মিনিটের এক ভিডিওতে দাবি করেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী সহিংসতা উসকে দিয়েছে।

জুনুনি বলেন, ‘৭৫ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও নৃশংসতা চালানো হচ্ছে। যে কারণে আমরা ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর হামলা চালিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা বার্তা দিতে চেয়েছি, যদি সহিংসতা বন্ধ না হয়, তাহলে নিজেদের রক্ষার অধিকার আমাদের আছে।’

উগ্রতাবাদ অধ্যয়নবিষয়ক ইউরোপীয় কেন্দ্রের অনাবাসিক ফেলো মাউং জারনি আলজাজিরাকে বলেছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যার মতো সিস্টেমেটিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছে এই গোষ্ঠীর (আরসা)। মিয়ানমারের সমাজের হৃদয়ে আঘাত করার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয় এটি কিন্তু তাদের সরকার তেমনটি দাবি করে থাকে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আশাহত মানুষদের একটি গোষ্ঠী এটি, যারা আত্মরক্ষা এবং নাৎসি বাহিনীর নির্যাতন ক্যাম্পের মতো অবস্থায় বসবাসকারী তাদের জনগণকে বাঁচানোর জন্য এটি গড়ে তুলেছে।’

চলতি বছরের ১৫ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরসা নেতা জুনুনির পোস্ট করা এক ভিডিওতে তিনি দাবি করেন, ‘মানুষ হিসেবে টিকে থাকার জন্য আমাদের আত্মরক্ষামূলক বৈধ লড়াইয়ের প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘তিন বছর ধরে আরাকানে আরসা আছে কিন্তু কখনো রাখাইনের মানুষের জানমালের ক্ষতি বা ধ্বংস করেনি।’

কিন্তু মিয়ানমার সরকার তাদের ভিন্ন রূপে উত্থাপনের চেষ্টা করছে এবং দাবি করছে, এরা মুসলিম সন্ত্রাসী, যারা ইসলামি আইন চালু করতে চায়।

আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক আনাগা নীলাকান্তন বলেছেন, এই গোষ্ঠীর এমন কোনো পরিষ্কার আদর্শ নেই, যা দিয়ে তাদের কাজকে অবমূল্যায়ন করা যায়। তিনি বলেন, ‘এই গোষ্ঠীটি রোহিঙ্গা বাঁচাতে লড়াই করছে, অন্য কিছু নয়।’

আনাগা নীলাকান্তন বলেছেন, বর্তমানে আরসার সদস্য সংখ্যা কত, তা পরিষ্কার নয়। তিনি আরো যুক্ত করেন, ‘স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক আছে বা সম্পর্ক তৈরির ইচ্ছা আছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই।’

আন্তর্জাতিক মহলের ভাষ্যমতে, আরসার সঙ্গে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের যোগাযোগ নেই। ফলে আল-কায়েদা বা আইএসের শাখা হিসেবে কাজ করার কোনো প্রশ্নই নেই। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, সরকার গুজব ছড়াচ্ছে। মিথ্যা বলা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর মতো মিথ্যা বলছেন সু চি।

মিয়ানমার সরকারের অভিযোগ, সম্প্রতি আরসার হামলার পর রাখাইনে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে তারা। ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত চলমান এই অভিযানের মুখে জাতিসংঘের হিসাবমতে ৩ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। নিহত হয়েছে সহস্রাধিক রোহিঙ্গা।

কিন্তু মিয়ানমার সরকার আরসাকে যেভাবে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে, আসলে তা নয়।

আল-কায়েদার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকার প্রমাণ না মিললেও বুধবার সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ দাবি করেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য মিয়ানমারকে শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আল-কায়েদা।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে সাইট ইন্টেলিজেন্সের বরাত দিয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে আল-কায়েদার কোনো নেতার নামধাম প্রকাশ করা হয়নি। এর আগে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার নিয়ে বিভিন্ন খবর প্রকাশ করেছে সাইট। কিন্তু সেসব খবরের সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি। বিশ্বে জঙ্গি কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। তবে এটি কীভাবে, কারা পরিচালনা করে, তা নিয়ে পরিষ্কার কোনো তথ্য নেই।