আর্জেন্টিনায়ও ওড়ে বাংলাদেশের পতাকা

‘ভেতরে আসো।’
দরজা খুলতেই আধো বাংলায় বলা কথাটি কানে এল। বসতেই বসতেই ছুটে এল আরেকটি বাক্য, ‘কেমন আছ?’
ছোট প্রশ্নবোধক বাক্যটি একজন আর্জেন্টাইনের মুখে ভারী মিষ্টি শোনাল। ‘আপনি তো দেখছি বাংলা শিখে গিয়েছেন?’ অট্টহাসিতে জবাব এল, ‘অল্প অল্প। নাও আমি বাংলাদেশি (হা… হা…)’

একজন আর্জেন্টাইনের নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে দাবি করা শুনলে কিছুটা অবাক হতেই হয়। কিন্তু পরের কথাটি শুনে বিস্ময়ের পারদ আরও চড়ল-আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে তাঁর বাড়িতে নাকি টাঙানো আছে বাংলাদেশের পতাকা। তিনি এরিয়াল কোলম্যান, বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে প্রথম ট্রেনার হিসেবে খুবই পরিচিত এক নাম।

প্রায় এক যুগ ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচয় এরিয়ালের। ২০০৫ সালে স্বদেশি কোচ আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানির সহকারী হিসেবে পা রাখা বাংলাদেশে। ২০০৭ সালে ক্রুসিয়ানির সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল তাঁকেও। কিন্তু এখনো বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এরিয়ালের নাম। বর্তমানে কাজ করছেন শেখ জামাল ধানমন্ডির ট্রেনার হিসেবে।

জামালের সঙ্গে কাজ করার আগে এরিয়াল জাতীয় দলের সঙ্গে কাজ করেছিলেন দুই দফায়। প্রথমে ক্রুসিয়ানির সঙ্গে। দ্বিতীয় দফায় ২০০৯ সালে ব্রাজিলিয়ান কোচ এডসন সিলভা ডিডোর সহকারী হিসেবে। এর পরে ২০১৪ থেকে শেখ জামাল ধানমন্ডির খেলোয়াড়দের শারীরিকভাবে ফিট রাখার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।

২০০৫ সালে বাংলাদেশের ফুটবলে শুরু হয়েছিল ক্রুসিয়ানি ও এরিয়ালের আর্জেন্টাইন যুগ। তাদের অধীনে আলফাজ, আরমান, জয়রা দুর্দান্ত ফুটবল খেলায় টানা দুটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে রানার্সআপ হয়েছিল বাংলাদেশ। প্রথমে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত গ্র্যান্ড রয়্যাল চ্যালেঞ্জ কাপে চীন অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে ২-০ গোলে হারিয়ে শুরু হয় তাদের মিশন। টুর্নামেন্টের ফাইনালে স্বাগতিকদের বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় বাংলাদেশকে। এরপর একই বছর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে পা রাখা বাংলাদেশ ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে হয় রানার্সআপ। যা বাংলাদেশের জন্য সাফে শেষবারের মতো ফাইনালের মঞ্চে পা রাখা।

শুরুর সেই স্মৃতিগুলো বুকে নিয়েই প্রায় এক যুগ ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এরিয়াল। এই দেশের মানুষের সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো যেমন আনন্দ দেয়, ঠিক তেমনি পোড়ায়ও, ‘অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে আছি। অনেক বন্ধু হয়েছে এখানে। মনে হয় এটা আমার নিজেরই দেশ। বলা যায় বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় বাড়ি।’

অথচ যখন ক্রুসিয়ানির কাছ থেকে বাংলাদেশে কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন, বাংলাদেশের নামও নাকি শোনা ছিল না। ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পেরেছিলেন তিনটি বিষয়-ছোট দেশ, অনেক জনসংখ্যা ও অনুন্নত। তাই পরিবার ও বন্ধুবান্ধবরা কেউ রাজি ছিল না এরিয়ালের বাংলাদেশে আসায়। প্রায় এক যুগের পরিক্রমায় এখন তো শুধু এরিয়াল-ই নন, বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে গিয়েছে পুরো আর্জেন্টাইন পরিবারটি। ২০১৫ সালে স্ত্রী ও দুই ছেলে এসে বাংলাদেশে বেড়িয়ে গিয়েছে এক মাস।

বাংলাদেশ থেকে আজেন্টিনায় ফিরে গিয়ে তাদের মুখে নাকি শুধু বাংলাদেশেরই গল্প। আর বেড়াতে এসে বাংলাদেশের পতাকা কিনে বুয়েনস এইরেসে ফিরেছে তার বড় ছেলে লুকাস। যা এখন শোভা পায় ঘরের দেয়ালে, ‘আমার বড় ছেলে বাংলাদেশে ঘুরতে এসে ভীষণ পছন্দ করে। পরে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে যায়। সবাইকে দেখিয়ে বলে আমার বাবা এই দেশে থাকে। বাংলাদেশের জার্সি পড়ে ঘুরে বেড়ায়ও সে।’

মাত্র এক মাস থেকেই বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে গিয়েছে ছেলে। সেখানে বাবার তো এক যুগের সম্পর্ক। এই লম্বা সময়ে বাংলাদেশের অনেক কিছুই তার হাতের তালুর মতো চেনা। ইচ্ছে হলেই রিকশা নিয়ে চলে যান ধানমন্ডি লেকে। কখনো মনে চাইলে রাস্তার দোকানগুলোতে বসে পেট ভরে খান চিকেন বিরিয়ানি। হাতের ইশারা দিয়ে দেখালেন লিচু তাঁর খুব প্রিয়। সব মিলিয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে এরিয়ালের। কিন্তু ফুটবলের ধারাবাহিক অবনতিটা পোড়ায় তাঁকে, ‘এখন বাংলাদেশের রাস্তাঘাট অনেক পরিষ্কার। রাস্তায় বের হলে বোঝা যায় অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে অনেক। শুধু ফুটবলটাই নিচের দিকে যাচ্ছে। ফুটবলের মানুষ হিসেবে ভীষণ কষ্ট লাগে।’

দুয়ারে দাঁড়িয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপ। মেসি থাকায় আর্জেন্টিনার সম্ভাবনা যে ভালোই, তা গর্বের সঙ্গে জানালেন বোকা জুনিয়র্সের সমর্থক এরিয়াল। বিশ্বকাপ চলাকালীন বাংলাদেশ জুড়ে উড়বে আর্জেন্টিনার পতাকা, ২০০৬ বিশ্বকাপে বাংলাদেশে অবস্থান করায় তা এরিয়ালের ভালোই জানা। তবে আর্জেন্টিনার একটি বাড়িতেও কিন্তু উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা!-প্রথম আলো’র সৌজন্যে