আশ্বাসেই দীর্ঘ ২৮ বছর পার ডাকসু নির্বাচন

দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হচ্ছে না। আচার্য, ভিসি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ক্যাম্পাসে সক্রিয় সব ছাত্র সংগঠন ডাকসু নির্বাচন চেয়ে আসছেন। আচার্যসহ সবাই আশ্বাসও দিয়েছেন। নতুন ভিসি আসার পর তারা ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছেন। আদালতের নির্দেশনাও আছে। এতকিছুর পরও এ লক্ষ্যে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে ডাকসু ছাড়াই চলছে আড়াই যুগ। এখন ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কারও আশ্বাসের ওপর শিক্ষার্থীরা আস্থা রাখতে পারছেন না।

এ অবস্থায় আগামী ৬ মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিকতা দেখাবেন তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘উচ্চ আদালতের রায়ের কপি এখনও আমরা হাতে পাইনি। তাই এ বিষয়ে মন্তব্যধর্মী বা বিশ্লেষণধর্মী কোনো মতামত দেয়া সম্ভব না। রায়ের কপি হাতে পেলে এ বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’

ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে। সে বছর ৬ জুন ডাকসু ও ১৮টি আবাসিক হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দীর্ঘ ২৮ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নিয়মিত নির্বাচন হলেও ডাকসু নির্বাচন দেয়া হয়নি।

বিশ্লেষকদের মতে, ২৮ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার মূল কারণ ক্ষমতাসীনদের একক নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর কোনো দলই ডাকসুর বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। অথচ বিরোধী শিবিরে থাকার সময় একই দলের নেতাদের ডাকসুর দাবিতে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও চায় না ছাত্র প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হোক। এ প্রক্রিয়া ছাত্র প্রতিনিধিরা যুক্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খেয়াল-খুশিমতো প্রশাসন চালাতে পারবে না। এটা তাদের ভয়ের কারণ। ডাকসু থাকলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে ছাত্ররা সোচ্চার হবে। এটা শাসক দলের বড় ভয়ের জায়গা। এ ছাড়া নিজ দলের ছাত্র সংগঠন ডাকসু নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলে ছাত্রদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ও তাদের মধ্যে কাজ করে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা হল- সরকার চায় না বলেই ডাকসু নির্বাচন হয় না। সরকার ভাবে, ডাকসু নির্বাচন হলে ছাত্রদের মতামত তাদের পক্ষে নাও যেতে পারে। আরেকটা সমস্যা হল, এ নির্বাচনকে সরকারের জনপ্রিয়তার অংশ হিসেবে নেয়া হয়। ফলে সরকার চায় না, তাদের জনপ্রিয়তার ভাটা প্রকাশ্যে আসুক। ফলে তারা নির্বাচন দেয় না।’ ডাকসু নির্বাচনকে অন্যান্য নির্বাচনের মতো একটি নিয়মিত ও স্বাভাবিক কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণেরও পরামর্শ দেন এ শিক্ষাবিদ।

২০১৭ সালের শেষদিকে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনিও ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেন। ডাকসু নির্বাচন দেয়ার ক্ষেত্রে তার দুটি বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একটি হল ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবরের হাইকোর্টের একটি আদেশ। এ আদেশে ছয় মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গ সিনেট গঠন করে ভিসি প্যানেল মনোনয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এ নির্দেশের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৫ সদস্যের সিনেট পূর্ণাঙ্গ করতে হবে। যার মধ্যে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি থাকতে হবে। দ্বিতীয় বাধ্যবাধকতা হল- বুধবার (১৭ জানুয়ারি) ৬ মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দিতে হাইকোর্টের নির্দেশ। ২০১২ সালের ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষার্থীর একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ নির্দেশ দেন আদালত।

এদিকে সবাই চাইলেও গত ২৮ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় এবারের হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়ন নিয়েও নানা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বর্তমান ও সাবেক ছাত্র নেতারা। তাদের মতে, এর আগে রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আচার্য মো. আবদুল হামিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সমাবর্তনে (৫০তম) বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ আ মাস্ট (হতেই হবে)। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’

এ বিষয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ডাকসুর ভিপি (১৯৭২) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর (রাষ্ট্রপতি) ডাকসু নির্বাচনের নির্দেশ দেয়ার পরও ভিসি নির্বাচনের আয়োজন না করে অন্যায় করছেন। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়।’ এ সময় তিনি একাডেমিক ক্যালেন্ডারে অন্য বিষয়ের পাশাপাশি ডাকসু নির্বাচনের তারিখ রাখারও দাবি জানান।

ডাকসুর সাবেক জিএস মোশতাক হোসেন (১৯৮৯-৯০) বলেন, ‘আমার তো মনে হয়, এবার যেভাবে জনমত সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচন করবেন। আর যদি কোনো অজুহাতে সেটি না হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেই জনমত যাবে। যারা নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করে, ধরে নেয়া হয় তারা নির্বাচনে ভালো ফল করবে না- এ আশঙ্কায় তারা এটি করেন। দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ায় এবার হবে কিনা তা নিয়ে একটা আশঙ্কা আছে। কিন্তু যেহেতু ৬ মাস সময় আছে, আমরা আশা করছি একটা ভালো সিদ্ধান্ত আসবে।’

এ বিষয়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি (১৯৯০) আমানউল্লাহ আমান বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনা আমাদের জন্য লজ্জার ব্যপার। নির্দেশ আসার আগেই এ নির্বাচন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমার মনে হয়, এ নির্দেশের পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকার করবে না। কারণ নির্বাচন দিতে হলে তার পূর্বশর্ত সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করা। এটি যতক্ষণ পর্যন্ত করা সম্ভব না হবে, ততদিন পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচন করা সম্ভব না। আর সরকারের সেই সদিচ্ছা নেই।’

জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৪ সালে। ১৯২৪-২৫ সালে প্রথম ডাকসুর ভিপি মনোনীত করা হয়। ডাকসুর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালে। এর আগে ভিপি মনোনীত ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ডাকসু গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে।

রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৯০ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু ২০১৮ সাল পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করেননি। ১৯৯০ সালের ৬ জুন সর্বশেষ নির্বাচনের এক বছর পর ১৯৯১ সালের ১২ জুন তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তখন ছাত্রনেতারা ছাত্রত্ব ঠিক রেখে প্রার্থী হওয়ার জন্য বিশেষ ভর্তির দাবি করেন। এ নিয়ে সৃষ্ট সহিংসতায় নির্বাচন ভেস্তে যায়।

পরে ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করেন। কিন্তু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার দোহাই দিয়ে ছাত্রলীগের বাধার মুখে নির্বাচন স্থগিত হয়। ১৯৯৫ সালেও ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেবারও নির্বাচন হয়নি। ১৯৯৬ সালে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পর একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমার কথা জানান। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় ব্যর্থ হন তিনি।

১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু হলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খুন হন ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ। ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৮ সালের ২৩ মে রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টে মেয়াদোত্তীর্ণ ডাকসু ভেঙে দেয়া এবং পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করা হয়। সে অনুযায়ী ২৭ মে সিন্ডিকেট সভায় ডাকসু ভেঙে দেয়া হয়। এরপরও অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী দু’বার নির্বাচনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তা-ও আলোর মুখ দেখেনি। ওই সময় বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অসহযোগিতার কারণেই ডাকসু নির্বাচন দেয়া সম্ভব হয়নি বলে দাবি করেন তৎকালীন উপাচার্য।

সে সময় ডাকসুর জন্য গঠিত নতুন (সংশোধিত) গঠনতন্ত্রে ডাকসু ভাঙার ৪ মাসের মধ্যে পুনরায় নির্বাচনের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত ডাকসুর তফসিল ঘোষণা হয়নি। ফলে নেতৃত্ব তৈরির ‘কারখানা’ হিসেবে পরিচিত ডাকসু আর কার্যকর হয়ে উঠেনি। ২০০৫ সালের মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ভিসি অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে একাধিকবার মিছিল, সমাবেশ ও ভিসির কাছে স্মারকলিপিও দেয়। সে দাবিও আলোর মুখ দেখেনি।

এরপর ২০০৯ সালে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করলে ডাকসু নির্বাচনের জোর দাবি ওঠে। দাবি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। শিক্ষার্থীরা আলাদা মঞ্চ করে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরপর বিভিন্ন সময় দফায় দফায় ডাকসু নির্বাচনের দাবি ওঠে। তার সময়কালে ২০১৭ সালের ২৯ জুলাই ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তারপর থেকেই ডাকসুর নির্বাচন দাবিতে টানা আন্দোলন করে আসছে শিক্ষার্থীরা। আরেফিন সিদ্দিক ডাকসুর পক্ষে বিভিন্ন সময় বক্তৃতা দিলেও নির্বাচনের বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি।

‘ডাকসুর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীবৃন্দের’ সমন্বয়ক মাসুদ আল মাহদী বলেন, ‘ডাকসুর কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা শুধু মুখে-মুখেই বলেছেন। যদি সত্যিকার অর্থেই ডাকসু নির্বাচন চাইতেন, তাহলে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। কিন্তু এ ধরনের কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম আমরা দেখিনি। যেহেতু ডাকসু একটি গণতান্ত্রিক দাবি, তাই কেউ এটিকে অস্বীকার করতে পারেন না। সে জন্য বাধ্য হয়েই ডাকসুর পক্ষে কথা বলেন, কিন্তু বাস্তবে কিছুই করেন না।’