ইংরেজি ও আইসিটিতে বিপর্যয় : সোয়া ৪ লাখের বেশি ফেল

উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় এবার সারাদেশে সোয়া ৪ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য। ইংরেজি ও আইসিটি (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) বিষয়ে ফেলের সংখ্যা বেড়েছে। ফল বিপর্যয়ে এ দুটি বিষয়ে ফেলের কারণকেই বড় করে দেখা হচ্ছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, ঘনঘন পরীক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের কারণে ফেলের সংখ্যা বেড়ে গেছে।

তবে এই ফলাফলকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তার মতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন, কড়াকড়ি আরোপ, প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস না হওয়া, মানের দিকে মনোযোগ দেয়ায় পাসের হার কমেছে।

বৃহস্পতিবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সারাদেশের ১০ বোর্ডে এ পরীক্ষায় এবার ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ হাজার ২৬২ জন। গত বছর এ পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৩৭ হাজার ৭২৬ জন। সেই হিসাবে এবার উচ্চমাধ্যমিকে পাসের হার কমেছে ২ দশমিক ২৭ শতাংশ। জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৮ হাজার ৪৬৪ জন।

ফলাফলে দেখা গেছে, ছাত্র-ছাত্রী উভয় মিলে এবার ৪ লাখ ২৯ হাজার ৯৫৬ পরীক্ষার্থী ফেল করেছে। এ বছর ১০ বোর্ডে অংশ নেয়া ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৭ হাজার ৯০৯ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৯৫৮ জন। পাসের হার ৬৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৫ হাজার ৫৮১ জন। এক লাখ ৮৪ হাজার ৬৬ জন ছাত্রীর কেউ পাস করতে পারেনি।

অপরদিকে, ৬ লাখ ৮০ হাজার ৮৪৮ জন ছাত্র এবার পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৪ লাখ ২৩ হাজার ৮৪৩ জন। পাসের হার ৬৩ দশমিক। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২ হাজার ৬৮১ জন। অকৃতকার্য হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৯০ জন ছাত্র।

ফেলের কারণ হিসেবে দেখা গেছে, এবার ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে ফল খারাপ হওয়ায় এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলে বিপর্যয় নেমেছে। এ কারণে কমেছে পাসের হার, বেড়েছে ফেলের সংখ্যা ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তীর সংখ্যাও। ফলে সব সূচক নিন্মমুখী হয়েছে।

এ বছর ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৭৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭২ দশমিক ৬৭ শতাংশ, কুমিল্লায় ৭৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যশোরে ৬৫ শতাংশ, চিটাগাংয়ে ৭৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ, বরিশালে ৭১ দশমিক ৬ শতাংশ, সিলেটে ৮২ দশমিক ৩৩ শতাংশ, দিনাজপুর বোর্ডে ৬৫ দশমিক ৫১ শতাংশ পাস করেছে।

অন্যদিকে, একই চিত্র আইসিটি বিষয়ের ফলাফলেও। এ বিষয়ে ঢাকা বোর্ডে ৮২ দশমিক ৮৩ শতাংশ, রাজশাহীতে ৯৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ, কুমিল্লায় ৯২ দশমিক ১৫ শতাংশ, যশোরে ৮৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, চিটাগাংয়ে ৮৩ দমিক ৯৪ শতাংশ, বরিশালে ৮৭ দশমিক ৬১ শতাংশ, সিলেটে ৯২ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং দিনাজপুর বোর্ডে ৮৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ পাস করেছে।

বিজ্ঞানের কয়েকটি বিষয়ের ফলাফল এগিয়ে থাকলেও পদার্থবিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগের ফলাফলে কিছুটা ধস নেমেছে। এসব কারণে ফলাফল নিন্মমুখী অবস্থা।

পরীক্ষার ফল মূল্যায়নে বৃহস্পতিবার জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ফেল করাটা মোটেও ইতিবাচক নয়। এদের অনেকে হয়তো আবারও পরীক্ষা দেবে, অনেকে ঝড়ে যাবে। ঘনঘন পরীক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের কারণে ফেলের সংখ্যা বেড়ে গেছে, যা পড়ালেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। বাড়ছে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা।

তিনি বলেন, এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলে ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ে ফেলের সংখ্যা বেশি। সব বোর্ডের শিক্ষার্থীরা সমান সুবিধা পাচ্ছে না। শিক্ষক সংকট, ভালো শিক্ষকের অভাবসহ নানা সমস্যার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষকরা সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করেন না। একই রকম উত্তর হলেও বৈষম্যমূলক মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় ফলাফলে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় এই অধ্যাপক।

বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এইচএসসি ও সমমানের ফলাফলের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পাসের হার কমলেও পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। পরীক্ষার খাতা যাতে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের বেশি পাস করলেও অপরাধ, কম পাস করলেও অপরাধ মনে করা হয়। মূলত মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে নানামুখী ব্যবস্থা ও কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। খাতা মূল্যায়নে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। তবে যেসব বোর্ডের ফলাফল পিছিয়ে তা নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষা আরও কঠিন হওয়া দরকার বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষার্থীরা ফেল করলে পড়ালেখার প্রতি মনোযোগ বাড়বে। তাই উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষা প্রশ্ন আরও কঠিন হওয়া দরকার। তবেই শিক্ষার্থীরা কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারবে।

‘আমাদের দেশে এখনো বড়কাজের জন্য বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। দেশের সন্তানদের মেধাবী হিসেবে তৈরি না করতে পারলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। আগে পাসের হার অনেক কম ছিল, পাসের হার যত বেড়েছে মেধার মূল্যায়ন ততই কমেছে’,- বলেন তিনি।

পাসের হার কমিয়ে মেধার সঠিক মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের ফলাফলে পার্থক্য ইতিবাচক না। অধিকাংশ বোর্ডে ইংরেজি, আইসিটি ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ফল খারাপ হয়েছে। কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। পাশাপাশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো শিক্ষক দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই সংকট কাটাতে সরকারি উদ্দোগে একটি শিক্ষা চ্যানেল চালু করা দরকার। নামিদামি ও ভালোমানের শিক্ষকদের ক্লাস ও কৌশল সে চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবে। তবেই আন্তঃবোর্ডের ফলাফল বৈষম্যদূরীকরণ সম্ভব হবে।

বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, অন্যান্য বোর্ডের চাইতে ঢাকা বোর্ডের ফলাফলে আমরা কিছুটা পিছিয়ে গেছি। ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ের পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে সার্বিক পদক্ষেপ নেয়া হবে।

উল্লেখ্য, এবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা ও কারিগরি বোর্ডের অধীনে সারাদেশে ২ হাজার ৫৪১টি কেন্দ্রে এই পরীক্ষায় ১৩ লাখ ১১ হাজার ৪৫৭ জন অংশ নেয়। পরীক্ষা শুরু হয় ২ এপ্রিল। লিখিত পরীক্ষা চলে ১৩ মে পর্যন্ত। ১৪ মে ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরু হয়ে ২৩ মে শেষ হয়।