ইটভাটা গিলছে কৃষিজমি, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক

অবৈধ ইটভাটা গিলছে রাজশাহী অঞ্চলের উর্বর ফসলি জমি। হেক্টরের পর হেক্টর জমির ওপরের স্তর ভাটার পেটে যাওয়ায় কমছে জমির উর্বরা শক্তি। নিম্নমানের কয়লা পোড়ানোয় বাড়ছে দূষণ। নষ্ট হচ্ছে ফসলের খেত, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হাজারও কৃষক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে উঠেছে লোকালয়ে। বাদ পড়েনি বিদ্যালয়ের আঙিনায়ও। ফসলি জমি উজাড় করে নতুন নতুন ইটভাটা গড়ে উঠছে এ অঞ্চলে। ফসলহানি ছাড়াও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়ছে মানুষ। সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে পর্যায়ক্রমে আইন অমান্যকারীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি দফতরের হিসাবে, এরই মধ্যে ইটভাটায় চলে গেছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরের এক হাজার ৬১৬ হেক্টর উর্বর কৃষিজমি। এ অঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জে সবচেয়ে বেশি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ইটভাটায় চলে যাওয়া সেখানকার ৫৩০ দশমিক ২৬ হেক্টর জমির পুরোটাই উর্বর ফসলি খেত।

এছাড়া রাজশাহীতে ৩২৫ হেক্টর, নওগাঁয় ৪৭০ হেক্টর এবং নাটোরের ২৯১ হেক্টর জমিতে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। তবে এ অঞ্চলে ইটভাটার সংখ্যা কত তা রেকর্ড নেই কৃষি দফতরে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুকনা মৌসুমে যেসব বিলে পানি থাকে না, সেসব বিলের ফসলি জমিতে ইটভাটা গড়ে উঠেছে বা উঠছে। এতে ফসলি জমি কমছে, চাপ পড়ছে কৃষির ওপর।

গত ছয় বছরে অন্তত ১৫০টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে রাজশাহী জেলায়। এখন ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৪০০। এর মাত্র ১৩টির নিবন্ধন দিয়েছে জেলা প্রশাসকের দফতর।

রাজশাহী পরিবেশ অধিদফতরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, রাজশাহী, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ইটভাটা রয়েছে ৮২৯টি। এর মধ্যে ১৭০টি ১২০ ফুট এবং ২৩৭টি ১৩০ ফুট উচ্চতার স্থায়ী চিমনির ইটভাটা।

সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী স্থায়ী চিমনি ইটভাটার সবগুলোকেই অবৈধ। বাকি ৪১৫টি জিগজ্যাগ এবং সাতটি হফম্যান হাউব্রিড ইটভাটাকে বৈধ বলা হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, কঠোর নজরদারির পর দেয়া হয় পরিবেশ ছাড়পত্র। ছাড়পত্র পাওয়া ভাটাগুলোতে চলে নজরদারি। নিয়মিত ব্যবস্থা নেয়া হয় আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে। জেল-জরিমানাও হচ্ছে। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) চারদিনে ১৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এতে জরিমানা আদায় হয়েছে ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবেশ অধিদফতরের কর্মী সঙ্কটে ব্যাহত হচ্ছে কঠোর নজরদারি। এ সুযোগে যত্রতত্র গড়ে উঠছে ইটভাটা। এগুলোর দু-একটির বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও বেশির ভাগই নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের কৃষি ও পরিবেশে।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার ড. আব্দুল আলিম জানান, ইটভাটা থেকে নির্গত ছাই আশপাশের গাছপালা ও ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ছাই ও বস্তুকণা গাছের পত্ররন্ধ্র বন্ধ করে দিচ্ছে, উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বষণ প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। কার্বনডাইঅক্সাইড ও সালফারডাইঅক্সাইড মিশ্রিত ছাই ধান, আম, কাঁঠাল, লিচু, শিম, কুমড়া, সরিষাসহ নানাবিধ ফসলের রেণুকে বিনষ্ট করছে। ফলে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক দেব দুলাল ঢালি। তার ভাষ্য, অনাবাদি কিংবা এক ফসলি জমিতে ইটভাটা নির্মাণ করা যায়। কিন্তু রাজশাহীর অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে উঠেছে দুই অথবা তিন ফসলি জমিতে। অনেক সময় ভাটা মালিকরা জমি কিনে নিয়ে কয়েক বছর অনাবাদি ফেলে রাখেন। পরে অনাবাদি দেখিয়ে ছাড়পত্র নেন। ভাটা মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় কৃষি দফতরের কিছুই করার থাকে না। এ নিয়ে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরকে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন তিনি।

জনবল সঙ্কটে কার্যক্রম জোরদার করা যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেছেন রাজশাহী পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, চিঠি দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু সাড়া মেলেনি।

তার দাবি, এ জনবল দিয়েই স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও কার্যক্রমে গতি আনতে প্রথম শ্রেণির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ আরও জনবল দরকার।

ইট প্রস্তুতকরণ ও ভাটা স্থাপন-সংক্রান্ত ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী, জেলা প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া ভাটা স্থাপন ও ইট পোড়ানো নিষিদ্ধ। এ আইন লঙ্ঘনকারী এক বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। কিন্তু রাজশাহীতে এ আইন লঙ্ঘন করেই বেশির ভাগ ইটভাটায় ইট বানানো ও পোড়ানোর কাজ চলছে।

যোগাযোগ করা হলে এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি রাজশাহী জেলা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও নেজারত ডেপুটি কালেক্টর শরীফ আসিফ রহমান।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলেন, লাইসেন্স নিতে ইটভাটা মালিকদের উৎসাহিত করছেন তারা। এছাড়া নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে মাঠ প্রশাসন। অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়াসহ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া চলমান বলেও জানান তারা।

এ বিষয়ে রাজশাহী ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি সাদরুল ইসলাম বলেন, নিবন্ধন প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ এবং জটিল। ফলে মোটা বিনিয়োগের পর পুরো প্রক্রিয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে অনেকেই ইটভাটা চালু করেন। এরই মধ্যে নিবন্ধনও পাওয়া যায়। বৈধভাবেই ব্যবসা করতে চান তারা।