ইয়াবা পাচারে নতুন কৌশল : অর্থের বিনিময়ে ‘পেট ভাড়া’!

মাদক পরিবহনে পেট ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি বিস্ময়কর হলেও সত্য। সমাজজীবনে বহুবিধ বিষয়ে বহু কিছু ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার বৈধ পন্থা প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে মাদক পরিবহনে পেট ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি।

মাদক পাচারের বিভিন্ন পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় এখন মাদক পরিবহনে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে মানবদেহের ‘পেট’। আর এ পেট বিভিন্ন অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ভাড়া দিচ্ছে রোহিঙ্গারাই।

মাদকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো অভিযান পরিচালিত হচ্ছে দেশের টেকনাফ অঞ্চলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ইয়াবা কারবারিদের প্রতিনিয়ত বন্দুকযুদ্ধসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে। একের পর এক খতম হচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। এরপরও মিয়ানমার থেকে সীমান্ত গলিয়ে ইয়াবা আসছেই।

উল্লেখ্য, দেশের সীমান্তসংলগ্ন টেকনাফ অঞ্চল দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসছে সেই নব্বই দশকের গোড়ার দিক থেকে। ইয়াবার আগ্রাসনে বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিবেচনায় এনে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে গত বছর থেকে শুরু হয়েছে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সব কয়টি সংস্থা তাদের অভিযান জোরদার করেছে টেকনাফ অঞ্চলভিত্তিক। ফলে এই টেকনাফে প্রতিনিয়ত ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধসহ নানা ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় মাদক ব্যবসায়ী চক্রের সদস্যদের লাশ পড়ছে একর পর এক। অভিযান শুরু করার পর থেকে বন্দুকযুদ্ধে ইয়াবা কারবারির প্রাণ হারানোর সংখ্যা অর্ধশতাধিক ছাড়িয়ে গেছে।

মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর সাগরপথের টেকনাফ অঞ্চলের রুটে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় ইয়াবা কারবারিরা চোরাই যেসব পথ বেছে নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ও বিস্ময়কর হচ্ছে ‘পেট’ ভাড়া নিয়ে ইয়াবা পাচার। অতীতেও মানুষের পায়ুপথসহ বিভিন্নভাবে ইয়াবার চালান পাচার হয়েছে। ধরাও পড়েছে। কিন্তু পেট ভাড়া নিয়ে ইয়াবার চালান পাচার ও তা ধরা পড়ার বিষয়টি বিস্ময়কর বলেই ঠেকছে। আর এ পেট ভাড়া দিচ্ছে রোহিঙ্গারা।

এসব রোহিঙ্গা এপারেই আশ্রিত। এরা সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে ওপারে যায়। সেখানে বিশেষ কায়দায় পায়ুপথ দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করিয়ে পেটভর্তি করে পরে তা এপারে নিয়ে আসছে। গত মার্চের শেষের দিকে মিয়ানমার থেকে টেকনাফ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এপারে আসা ২৩ রোহিঙ্গাকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সদস্যরা। এদের মধ্যে ১৩ রোহিঙ্গার পেট থেকে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা বের করা হয়েছে।

আটক রোহিঙ্গারা স্বীকার করেছে, তাদের প্রতিজনের পেট ইয়াবা পরিবহনের জন্য ২০ হাজার টাকায় ভাড়ায় খাটিয়েছে। টেকনাফ সীমান্তের ‘হ্নীলা’ চৌধুরী পাড়ায় ২৩ রোহিঙ্গা নারী ও শিশু আটক হওয়ার পর তাদের মধ্য থেকে ১৩ জনের পেটভর্তি মিলেছে ইয়াবা। এদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মাদক আইনে মামলা হয়েছে। গ্রেফতারদের তথ্য অনুযায়ী প্রতি মানুষের পেটে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ইয়াবার বড়ি ভর্তি করে নিয়ে আসা যায়। এ জন্য ইয়াবা কারবারিরা প্রতিজনকে ২০ হাজার টাকা প্রদান করে থাকে। মোটা অঙ্কের অর্থ প্রাপ্তির লোভে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্য এখন এ পথে নিজেদের প্রতিনিয়ত জড়াচ্ছে।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক জামাল উদ্দিন জানান, আগে থেকে বিভিন্ন পথে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসছে। অধিদফতরের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকারকে ৪৯ ইয়াবা উৎপাদন কারখানার তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব কারখানা দেশের সীমান্তসংলগ্ন ওপারের রাখাইন রাজ্যজুড়ে অবস্থিত। রাখাইনের চার জেলা মংডু, সিটওয়ে, বুচিদং ও রাচিদং জেলায় এসব কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গেল বছর দেশে ইয়াবা আটকের পরিসংখ্যান দিয়ে মহাপরিচালক জানান, এ সংখ্যা সাড়ে ৫ কোটিরও বেশি। তিনি জানান, বর্তমানে ইয়াবা চালান আসা ক্রমাগতভাবে কমে আসছে। তবে একেবারে রোধ করা যাবে কি না, তা বলা মুশকিল।

এদিকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে টেকনাফে আত্মসমর্পণ করেছে ১০২ ইয়াবা কারবারি। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে অর্ধ শতেরও বেশি ইয়াবা কারবারি। তবে এদের অধিকাংশই ইয়াবা বহনকারী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।

এছাড়া ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মূল গডফাদার এবং এ ব্যবসায় বিনিয়োগকারী এবং বিনিয়োগের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে মিয়ানমারে পাঠানোর সঙ্গে জড়িতদের প্রায় সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। ইতোমধ্যে যে ১০২ ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেছে তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ইয়াবা পাচারের বিপরীতে অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরণের সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যা প্রায় ৫০। এদের কেউ আত্মসমর্পণ করেনি, ধরাও পড়েনি।

দেশে ইয়াবা পাচার হয়ে আসার মূল রুট হচ্ছে বঙ্গোপসাগর, নাফ নদ ও স্থলপথ। ইঞ্জিন বোট, মাছ ধরার নৌকাযোগে বড় বড় চালান এসেছে। বিভিন্ন সংস্থা এ-জাতীয় চালান আটকও করেছে। বিজিবির পক্ষে ঘোষণা রয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সিল করা আছে। নাফ নদে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করা আছে। এরপরও ইয়াবার চালান আসছে।

বিভিন্ন সূত্রমতে, টেকনাফ ছাড়াও থাইনখালির রহমতের বিল, পালংখালি, কুতুপালং, ডেইলপাড়া, ডিগলিয়া পালং ও তুমব্রু এলাকা দিয়ে বর্তমানে ইয়াবার চালান আসছে।