ঈদের খুশি নেই, ছেলের কবরের পাশে বসে কাঁদছেন রিফাতের মা

ঈদের খুশি মেহমান হয়ে যায়নি বরগুনায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে নিহত হওয়া রিফাত শরীফের বাড়িতে। সবাই যখন কোরবানির গরু নিয়ে মাতোয়ারা তখন শোকের মাতাম চলছে রিফাতের বাড়িতে। গেল ঈদেও যে ছেলে বাড়িসহ পাড়াময় ঘুরে বেড়িয়েছে আজ সে সংবাদের শিরোমান ছাড়া আর কিছুই নয়।

ঈদ উপলক্ষে রান্নাবান্নাসহ অন্যসব প্রস্তুতি রেখে রিফাতের মা ডেইজি বেগম এখন ছেলের কবরের পাশে কেঁদে সময় পার করছেন।

রিফাতকে ছাড়া প্রথম ঈদ করছেন দুলাল শরীফ ও তার পরিবার। বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না রিফাতের স্বজনরা।

রিফাতের লবণগোলা গ্রামের বাড়িতে ঈদ আনন্দের ছিটেফোটাও নেই, চারিদিকে সুনসান নীরবতা।

গত ঈদে রিফাতের ছুটোছুটির কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা ডেইজি বেগম।

কান্নারত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার বাবা কোরবানিতে রুটি খাইত। কলিজা ভুনা খাইত। এখন কার জন্য এসব রাধব আমি! কি দরকার এই ঈদের!

খুব মা ভক্ত ছিল রিফাত, জানালেন বোন ইসরাত জাহান মৌ। মা অসুস্থ হলে পাশে বসে থাকত, নিজ হাতে মাকে খাইয়ে দিত বলে জানান তিনি।

এ কথা বলতে বলতে কান্না আর লুকিয়ে রাখতে পারেননি রিফাতের বোন।

এসময় ডেইজি বেগম বলেন, আহারে আমার বাবা। আমার বাবারে হারাইয়া আমি…বাবায় আমারে নিজের হাতে খাওয়াইত।এখন কে আমারে খাওয়াব?

মৌ বলেন, কোরবানি ঈদে রিফাতের প্রিয় খাবার ছিল নুডলস আর কাবাব। আমি আর কোনো ঈদে এ দুটি খাবার রান্না করতে পারব না। আমি নিজেও খেতে পারি না এগুলো। আমার হাতে রান্না করা নুডুলস আর কাবাব না খেলে ঈদই হতো না রিফাতের।

বিগত ঈদগুলোর স্মৃতিচারণ করে মৌ বলেন, প্রতি কোরবানি ঈদের দিন সকালে ভাইয়া আমার হাতের নুডুলস খেয়ে নামাজ পড়তে যেত। সকালে উঠেই বলত, ‘মৌ, নুডুলস রান্না কর।’ আমি রান্না করে দিতাম। নুডুলস খেয়ে নামাজ পড়তে যেত।

নামাজ পড়া শেষে বাবা-চাচাদের সঙ্গে গরু জবাই করে মাংস নিয়ে ফিরে কাবাব বানানোর বায়না ধরত রিফাত।

কলেজ যাওয়া মানেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্টকে ডিঙিয়ে যেতে হয় আমাকে, জানালেন মৌ।

বরগুনা সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। এই কলেজের গেটের সামনেই প্রকাশ্যে কুপিয়ে রিফাতকে হত্যা করে নয়ন বন্ডরা। আর সেই স্থানকেই মাড়িয়ে ক্লাসে যেতে হয় মৌকে।

তিনি জানান, মা এখনো ভুলে যান যে রিফাত আর নেই। বাইরে মটোরসাইকেলের আওয়াজ শুনলেই তিনি বলেন, মৌ মা, দরজা খোল, রিফাত আসছে’।

ভুল হয়েছে জেনে তখন কেঁদে ফেলেন তিনি।

মৌ বলেন, দুই ভাইবোন আর মা আর বাবা মিলে ছোট্ট একটি সুখের সংসার ছিল আমাদের। এক টুকরো সুখের ছবি। এখন অসুস্থ মা প্রতিদিন ভাইয়ার কবরের পাশে গিয়ে তিন-চার ঘণ্টা কান্না করেন। বিছানায় শুয়ে শুয়েও কাঁদেন। কখনও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।

যতই কাঁদুক রিফাত এখন শুধু স্মৃতি এ কথা জানিয়ে ডেইজি বেগম জোর দাবি করেন, আমার ছেলেরে যারা কুপিয়ে মেরেছে, তাদের কেউ যেন রেহাই না পায়। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার দেখে মরতে চাই। খুনিদের ফাঁসি চাই।

রিফাত হত্যায় জড়িতদের দ্রুত দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান বোন ইসরাত জাহান মৌ।

তিনি বলেন, মা-বাবাকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা নেই আমার। শুধু আমার ভাইকে যারা মেরেছে, আমি দ্রুত তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি দেখতে চাই। এটাই এখন সান্ত্বনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ জানান, আর কোনোদিন ঈদ আসবে না আমার ঘরে। ঈদে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করত রিফাত। আমি ওরে সেলামি দিতাম। বাবা-ছেলে মিলে একসঙ্গে ঈদের নামাজে যেতে পারব না আর। আমি পুরুষ মানুষ, তাই হাউমাউ করে কাঁদতেও পারি না। ছেলে নেই, আমার অবশিষ্ট আর কিছু নেই।

তবু কান্না চেপে তিনি বলেন, ছেলেকে তো আর ফেরত পাব না। হত্যাকারীদের বিচার দেখতে পারলে আত্মার শান্তি পাবে।

প্রসঙ্গত গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের গেটের সামনে রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে (২৩)। তিনি সদর উপজেলার বড় লবণগোলা গ্রামের দুলাল শরীফের ছেলে। হত্যা দৃশ্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে সারাদেশে তা আলোচিত হয়।

রিফাত হত্যার ঘটনায় মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। গ্রেফতার হয়েছেন রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। আরও গ্রেফতার রয়েছেন এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ১২ আসামি।