ঈদে ভারী বর্ষণ ও ভূমিধসের ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা শিবির

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর নিয়ে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে এবং বিভিন্ন এনজিও সংস্থার পক্ষ থেকে ঈদসামগ্রী দেওয়া হবে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের। এ বছর বর্ষার দুর্যোগ ও ভ‚মিধসের মতো নিরাপত্তাঝুঁকি মাথায় নিয়েই ঈদ উৎসব উদযাপন করবে আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গারা। তবু স্বস্তি যে আশ্রিত বাংলাদেশে অন্তত নির্ভয়ে ঈদের নামাজ পড়তে পারবে তারা।

সরকারি কর্মকর্তারা জানান, ঈদের বিশেষ কোনো আয়োজন না থাকলেও বিভিন্ন এনজিও তাদের জন্য মানসম্মত খাবার বিতরণ করবে বলে জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও ঈদের দিন বিশেষ খাবার সরবরাহের চেষ্টা চলছে এবং শিবিরের মধ্যেই ঈদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে রোহিঙ্গা পরিবারের প্রধানরা জানান, তাদের সন্তানদের জন্য ঈদের নতুন জামা পেলে ভালো লাগত।

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এফ ব্লকের মাঝি নুরুল ইসলাম জানান, গত বছরের ঈদুল ফিতরের দিন কেটেছিল আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে কুশলবিনিময় এবং ঈদের আনন্দ ভাগাভাগির অবস্থা ছিল। ছেলেমেয়েরা মংডু শহরে গিয়ে চার চাকার রিকশায় চড়েছে। এখন সেসব স্মৃতি। মিয়ানমারে সেনা নির্যাতন থেকে বাঁচতে গত বছর যখন বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে আসে, তখনকার আগুন, গুলি, হত্যা আর ধর্ষণের স্মৃতি এখনো ভাসছে তাদের মনে। এখন বাংলাদেশের শিবিরে কাটছে দিন। নেই নতুন পোশাক-আশাক কেনার অবস্থা। তিনবেলা খাবার জোটানোই যেখানে দায়। বিভিন্ন এনজিও, স্থানীয় লোকজন এবং সরকারের সহায়তায় জুটছে খাবার।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম আজাদ জানান, আপাতত রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদাভাবে ঈদ-আয়োজন নেই। তবে বেশ কিছু এনজিও এবং স্থানীয়দের উদ্যোগে বিভিন্ন শিবিরে রোহিঙ্গাদের ঈদের দিন বিশেষ খাবার সরবরাহের আয়োজন চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে সব এনজিওকে বলা আছে রমজান এবং ঈদ উপলক্ষে রোহিঙ্গাদের গুরুত্ব দিতে। কোন এনজিওর পক্ষ থেকে নতুন পোশাকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না। এমন কোনো আয়োজনের খবর নেই। তবে কেউ এগিয়ে এলে তা একটি ভালো উদ্যোগ হবে।’

জাতিসংঘ শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একজন মুখপাত্র জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা জানান, ‘আসলে ঈদ নিয়ে আলাদাভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো আয়োজনের খবর আমার কাছে নেই। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা ও এনজিওগুলো কিছু উদ্যোগ নিতে পারে।’ উখিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা জানান, যতটুকু জানা গেছে, তা হলো রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের মসজিদগুলোয় ঈদের নামাজ পড়বে। তাদের নিরাপত্তায় পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানান, ঈদ-উৎসবে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদাভাবে কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে তাদের খাদ্য সরবরাহের যে তালিকা রয়েছে, সেখানে ঈদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।

কদিন বাদেই ঈদ। পোলাও-গোশত, সেমাই বা নতুন কাপড় পাচ্ছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা রমিজউদ্দিন জানান, তিনবেলা পেট ভরে খাবারই যেখানে কষ্টের, সেখানে ঈদের জন্য আলাদা কোনো চিন্তা নেই। তিনি বলেন, স্ত্রী আর নয় সন্তানকে নিয়ে মিয়ানমার থেকে এসে গত মাসগুলো রোহিঙ্গা শিবিরেই কোনো রকম চলছে তার জীবন। আর যাই হোক এবার বাংলাদেশে ঈদের নামাজটা অন্তত শান্তিতে পড়তে পারব। আমরা তো মিয়ানমারে ঠিকমতো ঈদের নামাজও আদায় করতে পারতাম না।

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এফ ব্লকের মাঝি নুরুল ইসলাম জানান, ১ঈদের জন্য আমাদের আলাদাভাবে কিছু দেওয়া হয়নি। এখনো জানি না ঈদে সেমাই-শিন্নি-চিনি পাব কি না। আমাদের না দিলেও বাচ্চাদের জন্য নতুন জামা-কাপড় পেলে ভালো লাগত।’ রোহিঙ্গাদের একজন সৈয়দ করিম (৫৬) বলেন, গত বছর জীবনে প্রথম বাংলাদেশে খোলা আকাশের নিচে ঈদ কাটিয়েছেন। ঈদের নামাজও পড়া হয়নি। ছেলেমেয়েরা ক্ষুধার জ্বালায় কান্নাকাটি করেছিল। এবার অন্তত নামাজ পড়তে পারবেন এবং খাবার জুটবে।

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরেক বাসিন্দা রাবেয়া খাতুন জানান, ঈদসামগ্রী ও নতুন জামা না পেলেও মন খারাপ নেই। মিয়ানমারে কয়েক বছর ধরে বাচ্চাদের জন্য নতুন জামা কিনলেও ওই জামা পরে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ ছিল না, ঈদের নামাজে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। সেনাবাহিনী আর উগ্রপন্থি রাখাইনরা প্রতিনিয়ত নির্যাতন করত। শান্তিতে ঈদ-আনন্দ করা যেত না। কিন্তু এখানে সেই ভয় নেই।

এদিকে ঈদের আগে ভারী বৃষ্টিপাত ও ঝড়োবাতাসে গত শনি ও রোববার কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৬০-এর মতো দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এ দুর্ঘটনার মধ্যে পাঁচজনের মতো আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভারী বর্ষণ ও ভ‚মিধসে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর রাস্তাঘাট, কালভার্ট ও আশ্রয় শিবিরগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।

২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে বিশেষ অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, ধর্ষণ এবং বিতাড়ন শুরু করে সেখানকার সেনা ও পুলিশ। পরিস্থিতির শিকার হয়ে রাখাইন রাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। জাতিসংঘের মতে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমরা ‘বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু’। সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ‘জাতিগত নির্মূলের’ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।