উত্তরাঞ্চলে বন্যায় ৫০ কোটি টাকার ফসলহানির আশঙ্কা

উত্তরের প্রধান প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করলেও এখনো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমলেও জনদুর্ভোগ বেড়েছে। বেড়েছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। ঘর বাড়ি থেকে এখনো পানি না নামায় বন্যার্তরা বাঁধেই পড়ে আছে। দুর্গত এলাকায় পানিবাহিত রোগ ডায়েরিয়া, আমাশয় এবং জ্বরের প্রকোপ দিনদিন বাড়ছে। সারিয়াকান্দির একমাত্র হাসপাতালটি বন্যা কবলিত মানুষের স্বাস্থসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

এসব চিন্তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জমির ফসলহানি। চলতি বন্যায় উত্তরের সাত জেলা সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রামে ২২ হাজার ৪০৭ হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে ডুবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা বগুড়ায় ২৪ হাজার ২৫, সিরাজগঞ্জ জেলায় ৬৫ হাজার ৩০৯ জন। রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলা মিলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। টাকার অংকে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি।

এসব জমিতে আউশ ধান, পাট, আমন বীজতলা, রোপা আমন, বোনা আমন, শাবসবজি, মরিচ, আখ, কলার আবাদ ছিল। কৃষি অফিস বন্যার পানিতে নিমজ্জিত ফসলের জমির পরিসংখ্যান তৈরি করতে পারলেও পানি সরে না যাওয়া পর্যন্ত ফসলের ক্ষতির হিসাব করতে পারছে না। ফলে কী পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হবে সেই হিসাব পাওয়ার জন্য আরও সপ্তাখানেক অপেক্ষা করতে হবে।

বগুড়াসহ উত্তরের জেলাগুলোতে গত কয়েক দিন টানা বৃষ্টি, উজানের পাহাড়ি ঢল এবং ভারত তিস্তা ব্যারেজের সবগুলো গেইট খুলে দেয়ায় যমুনা নদীর পানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়েছে। এখনো যমুনর পানি বগুড়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৯, গাইবান্ধা পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র বিপদসীমার ৪২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

উত্তরের জেলাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার সফলি জমি এখনো পানির নিচে। অনেক জায়গায় দেখা গেছে ফসল নষ্ট হওয়ার আশংকায় অগ্রিম কেটে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে কিছু কিছু এলাকার কৃষক পানিতে পচে নষ্ট হওয়ার ভয়ে পরিপোক্ত হওয়ার আগেই পাট কেটে ফেলেছে। এতে যে পরিমাণ ফলন হওয়ার কথা তার অর্ধেক কিংবা আরও কম হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এতে এবার পাটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।

সরেজমিনে গাইবান্ধার ফুলছড়ির সাঘাটা এলাকা বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা ও কর্ণিবাড়ি, সোনাতলা উপজেলার মধুপর, তেকানি চুকাইনগর, পাকুল্লা, ধুনটের ভান্ডারবাড়ী, গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন ঘুরে সেখানকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তারা চলতি বন্যায় একদিকে নিজেদের থাকা খাওয়ার চিন্তায় আছে অপরদিকে মাঠে তাদের আবাদি ফসল নষ্ট হওয়ার আশংকায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।

কথা হয় সারিয়াকান্দি উপজেলার চরনামাপাড়া এলাকার চাষি ফজলুল হক, সাহেদ আলী, দিঘাপাড়ার ইফাজ উদ্দিন, আলফাজের সাথে। তারা জানান, প্রতি বছরের মতো এবারো তাদের জমিতে পাট চাষ করা ছিল। জুলাইয়ের শেষের দিকে অথবা আগস্টের প্রথম দিকে তাদের ফসল ঘরে উঠতো। অসময়ে বন্যা এসে তাদের পাটের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি এখনো ঠিকমত না কমায় পাট গাছের মাথা জাগেনি।

তারা আশংকার প্রকাশ করে জানান, দুই তিন দিনের মধ্যে জমি থেকে পানি সরে না গেলে হয়তো তাদের আবাদি এসব সফল একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে।

বন্যা দুর্গোত এলাকার জন্য বেশি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে আমন বীজতলা। আগামী আমন মৌসুমে বীজ সংকটের সম্ভাবনা এখনই দেখা দিয়েছে। যদিও কৃষি বিভাগ বলছে মৌসুম শুরুর আগেই আবারো বীজ তৈরি সম্ভব। যারা আগাম আমন চাষ করে তারা মৌসুমের শুরুই রোপন করতে পারবে না।

এদিকে শাকসবজিসহ কাঁচা মরিচের যে সব জমিতে পানি উঠেছে সেসব জমির ফসল ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়েছে। এতে বাজারে সবজিসহ কাঁচা মরিচের সংকট তৈরি হতে পাবে। তবে সেই সংকট স্থানীয় বাজারে হলেও সামগ্রিকভাবে তেমন প্রভাব পড়বে না বলে মনে করা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়া এবং রংপুর অফিসের তথ্য অনুযায়ী বগুড়ার তিন উপজেলা সোনাতলা ৯১০, সারিয়াকান্দি তিন হাজার ৮৭৫, ধুনট ৩০০ হেক্টর জমির ফসল পানির নিচে ডুবে গেছে। সিরাজগঞ্জ জেলার পাঁচ উপজেলা সদরে দুই হাজার ৪৮১, কাজিপুর ছয় হাজার ৪১০, বেলকুচি ৯৭০, শাহজাদপুর দুই হাজার ১৩৭, চৌহালী এক হাজার ৩৩৩ হেক্টর। রংপুর কৃষি অঞ্চলের গাইবান্ধায় ২৫৪ হেক্টর, কুড়িগ্রাম ৩হাজার ৬২০ হেক্টর, লালমনিরহাট ৫৯ হেক্টর, নীলফামারী ০৫ হেক্টর, রংপুর সদর ৫৩ হেক্টর জমির ফসল বর্তমানে পানির নিচে তলে আছে।

বগুড়া এবং সিরাজগঞ্জ কৃষি অঞ্চলে ৮৯ হাজার ৩৩৪ কৃষক, রংপুর অঞ্চলসহ লাখ ছাড়িয়ে যাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা।

কৃষি অফিস বলছে, পানি দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করলে ডুবে যাওয়া জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। বিশেষ করে এসব এলাকায় চাষকৃত পাট পানির নিচে পঁচে নষ্ট হওয়ার আশংকায় সময়ের অনেক আগেই বাধ্য হয়ে কাটছে কৃষকরা। এতে এবারের পাটের লক্ষমাত্র আর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। কাঁচা মরিচসহ সবজির সংকটও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে আশংঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৃষকরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ আলম জানান, চলতি বন্যায় বীজতলার ক্ষতি বেশি হওয়ায় আমরা কৃষকদের উঁচু জায়গায় বীজতলা তৈরির জন্য শুরু থেকেই পরমার্শ দিয়ে এসেছি। চলমান বন্যায় ফসলের ক্ষতি পুরণের জন্য কৃষি বিভাগ মাঠের চাষিদের সর্বক্ষণিক বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, এবার বন্যা আগাম হওয়ায় মাঠে খুব বেশি ফসল ছিল না। এই বন্যায় জমিতে পর্যাপ্ত পলি জমবে। এতে জমির ঊর্বরতা শক্তি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।

বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র সাহা জানান, বগুড়ায় বন্যা কবলিত তিন উপজেলায় তিন হাজার ৬০০ হেক্টর জমির ফসল একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। এতে শুধুমাত্র বগুড়ায় ফসলের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি হবে।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, বন্যা পরবর্তী প্রস্তুতি হিসেবে কৃষকদের মাঝে আমনের বীজ, চারা এবং পলি ব্যাগে বিভিন্ন সবজির চারা বিতরণ করা হবে।