এই সরকারের যত চ্যালেঞ্জ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছে৷ এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন৷ অধিকাংশ নতুন মুখের সমন্বয়ে গড়া এই মন্ত্রিপরিষদ, সরকারের সামনে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে শেখ হাসিনা ‘ডাবল রেকর্ড’ গড়লেন৷ চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া যেমন একটি রেকর্ড, তেমনি টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়াও রেকর্ড৷ আর জাতীয় সংসদে আসন পাওয়ার দিক থেকেও এবার স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের পর রেকর্ড গড়ল আওয়ামী লীগ৷ আওয়ামী লীগ থেকে ২৫৭ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন৷ আর মহাজোটের আসন হিসেব করলে সংখ্যাটা হবে ২৮৮৷ ২৯৮ আসনের এই হিসেবে বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট থেকে ৭ জন আর ৩ জন নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে৷

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা সোমবার শপথ নিলো, তাতে প্রধানমন্ত্রীসহ ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা৷প্রধানমন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রী ২৪ জন, প্রতিমন্ত্রী ১৯ জন এবং উপমন্ত্রী ৩ জন৷ তাঁদের মধ্যে নতুন ৩১ জন৷ আর ২৮ জন এই প্রথম মন্ত্রী হলেন, যাঁদের মধ্যে তরুণদের প্রাধান্য রয়েছে৷ মন্ত্রিসভা থেকে ছিটকে পড়েছেন আগের মন্ত্রিসভার ২৩ জন মন্ত্রী এবং ৯ জন প্রতিমন্ত্রী৷ এবারের মন্ত্রিসভায় ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্য থেকে কাউকে মন্ত্রী করা হয়নি৷ এবার জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসনে বসবে৷ তাই এবারের মন্ত্রিসভা ১৯৭৩ সালের পর এই প্রথম নিরঙ্কুশ ‘আওয়ামী মন্ত্রিসভা’৷ আর সংসদে আসন সংখ্যার দিক দিয়ে এককভাবে ১৯৭৩ সালের পর এই প্রথম সবচেয়ে বেশি আসন পেলো৷ স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন পেয়েছিল৷ আর এবার পেয়েছে ২৫৭টি আসন৷

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই এবারের আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷ সরকারে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এটা অভুতপূর্ব৷ এই অভুতপূর্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা ম্যানেজ করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷ কারণ, এখানে রিরোধী দল নেই বললেউ চলে৷ জবাবদিহিতার জায়গা একবারেই সংকুচিত৷ তাই জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাই মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রাধান্য পাবে৷”

তিনি বলেন, ‘‘পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন৷ শপথ নেয়ার আগেই তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজের স্থান হবে না৷এখন এটা বাস্তবে কতটা সম্ভব হবে সেটাই দেখার বিষয়৷ আমি এটা বলছি, কারণ, যে ফলাফলের কথা বলা হচ্ছে, এই ফলাফলের জন্য যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদেরও তো একটা চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার আছে৷ ক্ষমতায় থাকলে বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে সম্পদ বাড়বে এটা অনেকে বলেছেন, এই সংস্কৃতি আমাদের এখানে চালু আছে৷ কিন্তু এটা জনগণের স্বার্থের পরিপন্থি৷ এখন শাসনক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁরা বিষয়টি কিভাবে দেখবেন৷ আমার মনে হয়, এই ক্ষেত্রে একটা বড় ঝুঁকি আছে সরকারের৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী ইশতাহারে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলেছেন৷ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু এর সাথে সব মানুষের বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ আমি মনে করি, উন্নয়নের সঙ্গে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতার সঙ্গে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷ সরকারের জন্য এটাও বড় চ্যালেঞ্জ৷”

আর মানবাধিকার কর্মী এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে৷ আগে যখন আমরা নাগরিকরা কোনো দাবি তুলেছি, তখন তারা বলেছেন নানা ধরনের বাধা ও বিরোধিতার কারণে তারা অনেক কিছু করতে পারছেন না৷ এখন তো আর সেটা নেই৷ ফলে তারা নাগরিক কল্যাণে কী করেন তা দেখতে চাই৷”

তিনি বলেন, ‘‘এখন তাঁরা বলছেন, তাঁরা জঙ্গিবাদ পরাভূত করেছেন, মৌলবাদ পরাভূত করেছেন, তাঁদের বড় যে অপজিশন বিএনপি, তাঁদের ভাষায় জনগণ তাঁদের প্রত্যাখ্যান করেছে৷ তার মানে, তাঁদের যে নীতি ও কর্মসূচি আছে, তার প্রতি প্রচুর জনসমর্থন আছে৷ এখন তাঁদের ইশতাহার, সংবিধান ও সাংবিধানিক অধিকার তাঁরা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করে , মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা উচিত৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে৷ সংবিধানের সবচেয়ে বড় যে কথাটা বলা হয়েছে, তা হলো, মানবসত্বার মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার, যার সাথে সুশাসন, দুর্নীতি দমন, মানুষের ন্যায় বিচারের প্রাপ্যতা, মর্যাদার সাথে মানুষের জীবন যাপন করাও (রয়েছে)৷ মানুষ যেন অন্যের ওপর নির্ভর না করে,স্বাধীনভাবে আত্মমর্যাদার সাথে জীবন যাপন করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করাই এই সরকারের বড় কাজ বা চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি৷”

এদিকে শপথ নেয়ার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বঙ্গভবনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘এই নতুন সরকারের কাজ হলো আমাদের প্রতিশ্রুতি এবং ইশতাহার অক্ষরে অক্ষরে পালন ও বাস্তবায়ন করা৷”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কেউ বাদ পড়েছেন এটা ভাবা ঠিক হবে না৷ সবার দায়িত্ব এবং কাজ আছে৷ আমরা দল ও সরকারকে আলাদা করতে চাই৷ সরকার ছাড়াও দলের জন্য কাজ করার আছে৷ আমরা দলকে আরো শক্তিশালী এবং সংগঠিত করতে চাই৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘১৪ দলীয় জোটের কেউ এখনো মন্ত্রীত্ব পাননি, এর মানে এই নয় যে জোট থাকবে না বা ভেঙে গেছে৷ জোট আছে। আমরা একসঙ্গে কাজ করবো৷” আর নতুন মন্ত্রীরা বলেছেন,‘‘মন্ত্রীত্ব পভোগের বিষয় নয়। এটা দায়িত্বের বিষয়৷ আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকব৷”-ডয়চে ভেলে