এক বিকেলে মান্না দে’র কফি হাউজে

‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই.. আজ আর নেই…। কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই…।’ এটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী মান্না দে’র কালজয়ী গানের দুটি লাইন।

সম্প্রতি আমি মান্না দে’র চিরসবুজ গানের সেই কফি হাউজে একটা বিকেল কাটিয়ে এলাম। আমার কলকাতা ভ্রমণ নিয়ে লেখা ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্ব আজ তুলে ধরলাম।

সময়টা ছিল বিকেল ছুঁই ছুঁই। কলকাতার নন্দন থেকে ৫ রূপিতে পাতাল ট্রেনে চড়ে গেলাম কলেজ স্ট্রিট। কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিতর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম কফি হাউজের সন্ধানে। হাঁটতে হাঁটতে চোখ পড়ল একটা লুচির দোকানে। তারপর সেখান থেকে খেলাম কয়েকটা লুচি সঙ্গে আলুর দম। শুকনো পাতার বাটিতে আলুর দম ও গরম গরম লুচি খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা!

খাওয়া শেষে অল্প একটু হাঁটতেই পেয়ে গেলাম কাক্সিক্ষত কফি হাউজটি। প্রেসিডেন্সি কলেজ গেটের উল্টোদিকের বাঁয়ের গলিতে ঢুকলেই চোখে পড়বে বিখ্যাত ‘ইন্ডিয়ান কফি হাউস’। যেটি এখন মান্না দে’র কফি হাউজ নামে প্রসিদ্ধ। কফি হাউজ সংলগ্ন সড়কে ঢাকার নীলক্ষেতের মতো চিরচেনা বইয়ের সহস্র দোকান আমাকে বিমোহিত করেছিল। সেখানে গেলে বইপাড়ার এমন দৃশ্য সবারই চোখে পড়বে!

এদিকে বাহির থেকে কফি হাউজ ভবনে দৃষ্টি পড়তেই আমার মনটা ভেঙে গেল। পুরাতন জরাজীর্ণ পরিত্যক্তের মতো দেখাচ্ছিল ভবনটি। এমন জরাজীর্ণ ভবনটাকে সেই বিখ্যাত কফি হাউজ হিসেবে কেন জানি মানতে পারছিলাম না। হোক না সেটা শত বছরের কুঠির, তবুও কি তুলির আঁচড়ে নয়নের কাছে ভরা যৌবন ফেরানো যেতো না?

একটু মন খারাপ নিয়েই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। দোতলায় উঠতেই চোখে পড়লো ‘কফি হাউজ’ লেখা সাইনবোর্ড। এরপর দরজা দিয়ে ভিতরে একটু উঁকি দিতেই চমকে উঠলাম। বাহির থেকে দেখলাম একটা জরাজীর্ণ ভবন, আর ভিতরে এসে একি দেখছি! অডিটোরিয়ামের মতো দোতলার বিশাল রুমটি লোকে লোকারণ্য। সবাই গল্প, আড্ডায় মত্ত। চারিদিকে হৈ চৈ আর হৈ চৈ! সেখানে বসার মতো একটি সীটও খালি পেলাম না।

দোতলা থেকে গেলাম তিনতলায়। তারপর ভিতরে ঢুকেই যেন প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। দেয়ালের নানা প্রান্তে টাঙানো রয়েছে বিখ্যাত সব শিল্পীদের চিত্রকর্ম। দ্বিতীয় তলায় সারি সারি পঞ্চাশ-ষাটটার মতো সাজানো ছিল গোলটেবিল। তবে তৃতীয় তলাটি ছিল বেশ ভিন্ন রকমের। এটি দেখতে থিয়েটার বা গ্যালারির মতো। সেখানেও চারদিক থেকে টেবিল সাজানো।

একটা টেবিলে বসলাম। কফির অর্ডার দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই মাথায় পাগড়ি পরা ষাটোর্ধ্ব একজন বেয়ারা কফি নিয়ে আসলো। কফির পেয়ালায় চুমুক দিতেই হারিয়ে গেলাম মান্না দে’র ওই বিখ্যাত গানের মাঝে। গুনগুন করে গাওয়া শুরু করলাম গানটি। ওই সময়ের মুহূর্তটা ছিল কল্পনাতীত। উল্লেখ্য, এখানে পাঁচ পদের কফির পাশাপাশি চায়নিজ আইটেম ও বিভিন্ন স্ন্যাকস পাওয়া যায়। দামও ততো বেশি নয়। কফি’র পেয়ালা ১৬ রুপি থেকে শুরু। এরপর দাম চাহিদা অনুয়ায়ী বাড়ে। তবে ক্রিমসহ কোল্ড কফির দাম সর্বোচ্চ।

প্রতিদিন হাজারো মানুষের কলরবে মুখরিত হয় কলকাতার এই কফি হাউজটি। নিকটতম স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও লেখক, সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাদার, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকরাও আড্ডা জমান এখানে। প্রেমিক যুগলদেরও রয়েছে বেশ আনাগোনা।

মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ বসু, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বাঙালি অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো কত বিখ্যাত ব্যক্তিরা এক সময় আড্ডা দিয়েছেন এই কফি হাউজে!

২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর পরলোকগমন করেন মান্না দে। তবে তার গানের সাত কাল্পনিক চরিত্র এখনও আছে কফি হাউজে। যা এভাবে ব্যক্ত করেছিলেন তিনি- ‘সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে/সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই/একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি/শুধু সেই সেদিনের মালি নেই।’

উইকিপিডিয়ার দেয়া তথ্যে জানা যায়, উত্তর কলকাতার বইপাড়া কলেজ স্ট্রিট চত্বরে কফি হাউজটি অবস্থিত। কফি হাউজের নাম প্রথম দিকে ছিল না। এটি ছিল বিরাটাকৃতির হল। যেখানে মানুষের জমায়েত হতো। ১৮৭৮ সালের এপ্রিলে তৎকালীন বৃটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের নামকরণে এটির নামকরণ করা হয় ‘অ্যালবার্ট হল’। এরপর ১৪০ বছর কেটে গেছে।

১৯৫৭ সালে এটি কফি হাউজে রূপ লাভ করে। যা ইন্ডিয়ান কফি হাউজ বা কফি হাউজ নামে পরিচিতি হতে থাকে। একসময় কফি হাউজ ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে শ্রমিক সমবায়ের আওতায় আসে। বাঙালির প্রাণের এ আড্ডাস্থলটি উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে।

লেখক : আবু রায়হান মিকাইল, গণমাধ্যম কর্মী