এত বড় ঢেউ আঘাত হানবে ভাবেনি কেউ

ভূমিকম্প আর সুনামির আঘাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে ইন্দোনেশিয়ায়। পালু শহরে আঘাত হানা সুনামির ঢেউ ছিল ৬ মিটার বা প্রায় সাড়ে ১৯ ফুট উঁচু। ভূ-প্রাকৃতিকভাবে ইন্দোনেশিয়া এমন একটি দেশ যেখানে ভুমিকম্প প্রায় প্রতিদিনই আঘাত হানে। কিন্তু পালুতে ভুমিকম্প থেকে এত বড় ঢেউ সৃষ্টি হলো কেন তা নিয়ে স্থানীয় মানুষদেরতো বটেই বিজ্ঞানীদেরও বিস্মিত করেছে।

এই সুনামির আঘাতে পালু শহরে এখন পর্যন্ত ১৩০০-য়ের বেশি লোক নিহত হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার যে ভুমিকম্পটি হয়েছে তা থেকে এমন ভয়ংকর সুনামি হবে তা অনেকেই ভাবতে পারেননি। এর পেছনে কাজ করেছে পালুর ভৌগলিক অবস্থান, সময়, আর দুর্বল পূর্ব-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা।

একটা নির্দিষ্ট মাত্রার ভুমিকম্প হলে কি হতে পারে, কতটা ক্ষতি হতে পারে তা নানা রকমভাবে অনুমান করা যায়। পালুর ক্ষেত্রে যা হয়েছে- বিজ্ঞানীরা বলছেন, সবচেয়ে খারাপ যা হতে পারে ঠিক সেটাই হয়েছে। বিজ্ঞানীরা দুর্যোগের সময়ের পুরো দিনের ঘটনার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন।

শুক্রবার সারাদিন ধরেই ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ গুরুতর ঘটনা ঘটে। মাটির ৬ মাইল নিচে ভূ-স্তরের যে টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থল – যাকে বলে পালু-কোরু ফল্ট – আকস্মিকভাবে তা পিছলে যায়। এই জায়গাটা পালু উপকূলের অল্প দূরেই অবস্থিত।

ভূস্তরের এই বিশেষ ফাটলটি নিয়ে ১৯৯৫ সাল থেকে গবেষণা করছেন বান্দুং ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির হামজা লতিফ। তিনি বলেন, পালু শহরটি গড়ে উঠেছে পলিমাটির পুরু স্তরের ওপর। আর ভূমিকম্পের আঘাতে পাথুরে মাটি যতটা নড়ে, তার চাইতে পলিমাটি নড়াচড়া করে অনেক বেশি। তাই এর ওপর তৈরি করা খুব কম ইমারতই সেই আলোড়ন সহ্য করতে পারে।

যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোহাম্মদ হায়দার জাদেহ বলেন, আমার হিসাবে পালুতে সমুদ্রের তলদেশে বিকৃতি (ডিফরমেশন) ঘটেছে ৪৯ সেন্টিমিটার। এতে সুনামির ঢেউ এক মিটারেরও কম উঁচু হবার কথা। ৬ মিটার হবার কথা নয়। কাজেই অন্য কিছু একটা ঘটেছে।

সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফিলিপ লিউ লি-ফ্যান বলেন, পালু-কোরু ফল্ট লাইন নিয়ে আমরা খুব বেশি ভাবতাম না। কারণ এখানে টেকটোনিক প্লেট দুটো নড়াচড়া করে ডানে-বাঁয়ে, ওপরে-নিচে নয়। তাই বিপজ্জনক ঢেউ সৃষ্টি হবার ঝুঁকি কম।

কিন্তু এবার ঠিক তাই হয়েছে। কেন এমন হলো? আমরা বের করার চেষ্টা করছি কি ঘটেছে। হতে পারে যে ভূমিকম্পের ফলে হয়তো সাগরের তলদেশে একটা ভূমিধসের সৃষ্টি হয়েছিল, অথবা ফল্ট-লাইনটাও অন্যরকম আচরণ করে থাকতে পারে। তবে কি হয়েছিল তা আমরা এখনো জানি না।

সুনামি যখন সৃষ্টি হলো তখন সরু একটা ১০ কিলোমিটার লম্বা উপসাগরের এক মাথায় গড়ে ওঠা পালু শহরের বাঁচার কোন সুযোগ ছিল না। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে পালুতে আঘাত হানে তিনটি ঢেউ।

যেহেতু উপসাগরটা সরু, তার ওপর ঘোড়ার খুরের আকৃতির তাই ঢেউগুলো ক্রমাগত বড় হচ্ছিল। এগুলো দু’পাশের তীরে আঘাত হানতে হানতে এগুচ্ছিল। লতিফ বলেন, পালুতে আগেও সুনামি হয়েছে। ১৯২৭ সালের সুনামিতে উপসাগরের মুখে ঢেউটা ছিল ৩ থেকে ৪ মিটার উঁচু। কিন্তু পালুর উপকূলে পৌঁছানোর সময় তা বেড়ে ৮ মিটার অর্থাৎ প্রায় ২৫ ফিট উঁচু হয়ে যায়।

২০০৪ সালে সুনামিতে মারা গেছে আড়াই লাখ মানুষ। এরপর পুরো অঞ্চল জুড়ে সুনামির আগাম সতর্কতার জন্য বহু সেন্সর বসানো হয়। প্রফেসর লিউ বলেন, এ ব্যবস্থা কাজ করেনি। আসলে ২০১২ সাল থেকেই অনেকগুলো সেন্সর নষ্ট হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।