এবার উল্টো চিত্র সেই কোম্পানিগুলোর

চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয় প্যাসিফিক ডেনিমসের। ওই দিন লেনদেন শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম দাঁড়ায় ২৬ টাকা ৫০ পয়সা। এরপর ৫ মার্চ দাম বেড়ে হয় ২৮ টাকা ৬০ পয়সা। লেনদেন শুরু প্রথম এক মাস এভাবেই দাম বাড়ে প্রতিষ্ঠানটির ১০ টাকা মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের। অর্থাৎ লেনদেন শুরুর প্রথম এক মাসে প্যাসিফিক ডেনিমসের শেয়ার দাম বাড়ে ১৮৬ শতাংশ।

তবে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দর বৃদ্ধির এ রথ। ৫ মে’র পর থেকে অনেকটা ধারাবাহিকভাবেই প্যাসিফিক ডেনিমসের শেয়ার দাম কমেছে। টানা দাম কমে ২১ মে প্রতিটি শেয়ারের দাম নেমে আসে ২১ টাকা ৩০ পয়সায়। তবে জুলাই মাসে বাজারে উল্লম্ফন দেখা দেয়ায় এ প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দামও আবার বাড়তে থাকে। ২৬ জুলাই লেনদেন শেষে শেয়ারের দাম বেড়ে ২৬ টাকা ৯০ পয়সায় পৌঁছে যায়।

লেনদেন শুরুর প্রথম মাসের মতো এবারও মূল্য বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকেনি। ২৬ জুলাইয়ের পর থেকে আবার ধারাবাহিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের মূল্য কমেছে। ২৮ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে প্যাসিফিক ডেনিমের দাম দাঁড়িয়েছে ২২ টাকা ২০ পয়সা।

শুধু প্যাসিফিক ডেনিমস নয়, বর্তমানে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানির তালিকায় বা ‘এন’ গ্রুপে থাকা সব কোম্পানির তথ্য পর্যলোচনা করে একই অবস্থা পাওয়া গেছে। বর্তমানে এন গ্রুপে কোম্পানি আছে পাঁচটি। অন্য চারটি হলো, ফরচুন সুজ, নূরানী ডাইং, বিবিএস কেবলস এবং শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। লেনদেনের প্রথমদিকে এই কোম্পানিগুলোর সব ক‘টির দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এরপর শেয়ার দাম ধারাবাহিকভাবে কমে গেছে।

তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত আগস্ট মাসেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লেনদেনে বড় ধরনের দাপট দেখায় এন গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো। জুলাই মাসের শেষ দিন বিবিএস কেবলসের লেনদেন শুরু কারণেই মূলত দাপট দেখায় এন গ্রুপ। ডিএসইর মোট লেনদেনে এন গ্রুপের অংশ চলে যায় ৮ শতাংশের ওপরে। তবে বিবিএস কেবলসের লেনদেন শুরুর এক মাস পর থেকেই আবার একই চিত্র দেখা গেছে। বর্তমানে ডিএসইর মোট লেনদেনে এন গ্রুপের অংশ কমে অর্ধেক বা ৪ শতাংশে চলে এসেছে।

লেনদেন শুরুর পর এক মাসের মধ্যে বিবিএস কেবলসের ১০ টাকা মূল্যের শেয়ারের দাম বেড়ে দেড়’শ টাকায় পৌঁছে যায়। এরপর পরিণতি যা হওয়ার ঘটেও তাই। ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে কোম্পানিটির শেয়ার দাম। দেড়’শ টাকা থেকে কমতে কমতে ২৮ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে বিবিএস কেবলসের শেয়ার দাম দাঁড়িয়েছে ১৩০ টাকা ৩০ পয়সায়।

লেনদেন শুরুর দিকে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং এরপর ধারাবাহিকভাবে কমার বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ বিনিয়োগকারী কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করে না। তারা মূলত বাজারে যখন যে গুজব চলে তার ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ করে। ফলে বিভিন্ন চক্র বাজারে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে শেয়ার দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটে নেয়। শেয়ার দাম বৃদ্ধির পর ওইসব চক্র তাদের কাছে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে ছিটকে পড়ে এবং তার পর থেকেই শেয়ারের দাম কমতে থাকে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কোন কোম্পানির শেয়ারের চাহিদা বেড়ে যায়, তখন ওই কোম্পানির শেয়ার দাম হুট করে বেড়ে যায়। তবে সব সময় এ চাহিদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত কোন সঠিক কারণ থাকে না। মূলত গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীরা এ বিনিয়োগ করে। ফলে একটা পর্যায়ে এসে শেয়ার দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে।

বিএসইর আরেক সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, শেয়ারবাজারে একটি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন শুরুর প্রথমদিকে ওই কোম্পানির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশি থাকে। এতে হুট করে শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। শুরুতেই কোন কোম্পানির দাম হুট করে বেড়ে যাওয়া বাজারের জন্য ভালো না। কিন্তু এটা বন্ধ করার কোন উপায় নেই। কেউ যদি বিনিয়োগ করতে চায়, তাকে ঠেকানো যাবে না। মূলত আমাদের বিনিয়োগকারীরা যথেষ্ট পরিপূর্ণতা (দক্ষ) লাভ করেনি, যে কারণে এমন চিত্র দেখা যায়। তবে যারা চালাক তারা দাম কমার আগেই বিক্রি করে দেয়।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, এন গ্রুপের কোম্পানিগুলোর দাম ও লেনদেন চিত্র দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, লেনদেন শুরু হওয়ার প্রথম কয়েকদিন দাম হু হু করে বাড়ছে। কিছুদিন দাম বাড়ার পর এক পর্যায়ে এসে টানা দাম কমে যাচ্ছে। এমন হুট করে দাম বাড়ার পেছনে যেমন গুজব কাজ করছে, তেমনি রেগুলেটরি (নিয়ন্ত্রণ) দুর্বলতাও রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে না হওয়ার কারণেই নতুন কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে এবং এক পর্যায়ে এসে দাম কমে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ১০ টাকার একটি শেয়ার এমনি এমনি দেড়’শ টাকায় পৌঁছে যেতে পারে না। এটাকে কিছুতেই স্বাভাবিক বলা যায় না। একটি কোম্পানি ১০ টাকা মূল্যে শেয়ারবাজারে আসল, আর তালিকাভুক্তির পরপরই তার আর্থিক অবস্থার কি এমন পরিবর্তন ঘটল শেয়ার দাম ১৪শ’ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে। নিশ্চয় কোন বিশেষ চক্র এমন দাম বাড়ার পেছনে রয়েছে। দাম বাড়ার পর ওই চক্র তাদের ফায়দা লুটে শেয়ার ছেড়ে দিয়েছে। যার প্রভাব এখন শেয়ার দামে দেখা যাচ্ছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে দাম কমছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত যারা এমন দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটেছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা না হলে এমন ঘটনা বারবার ঘটতে থাকবে এবং এক শ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ধরা খাবেন।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ২০ অক্টোবর লেনদেন শুরু হওয়া ফরচুন সুজের ১০ টাকার শেয়ার প্রথম দিনেই লেনদেন হয় ৬০ টাকায়। এরপর কিছুদিন দাম কমলেও ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিটি শেয়ারের দাম ৬২ টাকা ৯০ পয়সায় পৌঁছে যায়। তবে এ পর্যায়ে এসে অনেকটা ধারাবাহিকভাবেই কমেছে ফরচুন সুজের শেয়ার দাম। ২৮ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম দাঁড়িয়েছে ৫২ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ সেপ্টেম্বর মাসের শরুতেও কোম্পানিটির শেয়ার ৬১ টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে।

চলতি বছরের ১ জুন লেনদেন শুরুর প্রথম দিন নূরানী ডাইং-এর শেয়ার দাম দাঁড়ায় ২০ টাকা ৮০ পয়সা। এরপর দাম বাড়তে বাড়তে তা ১২ জুলাই ২৭ টাকায় পৌঁছে যায়। এ পর্যায়ে এসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম কমতে থাকে। ২৮ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ার দাম দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা ৭০ পয়সা। তবে গত ১৮ সেপ্টেম্বরও প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম ২৩ টাকার ওপরে ছিল।

এন গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠান শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজের লেনদেন শুরু হয় গত ৮ মার্চ। প্রথম দিনের লেনদেন শেষে প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ৫৩ টাকা ১০ পয়সা। পরের কার্যদিবসে তা বেড়ে হয় ৫৫ টাকা ৪০ পয়সা। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২৮ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার দাম দাঁড়িয়েছে ৩৭ টাকা ৬০ পয়সা। অথচ চলতি মাসের শুরুতেও কোম্পানিটির শেয়ার দাম ৪০ টাকার ওপরে ছিল।