এবার বজ্রপাতের পূর্বাভাস মিলবে

ভূমিকম্পের মতো বজ্রপাতেরও আগাম আভাস পাওয়ার ব্যবস্থা দেশে এখনো নেই। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর এবার দেশের আটটি স্থানে এমন যন্ত্র বসাচ্ছে, যার মাধ্যমে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়া যাবে। বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতির এই পদক্ষেপ এল।

আবহাওয়া বিভাগ বলছে, এই প্রযুক্তি আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে সুফল বয়ে এনেছে। তবে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে যন্ত্রটি কতটা ভূমিকা রাখবে, তা এর কার্যকারিতা না দেখে বলা সম্ভব নয়।

জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি-১) মো. মোহসীন বলেন, বজ্রপাত এখন দেশের নতুন দুর্যোগ। সরকার বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বজ্রপাতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে দেশের আটটি স্থানে সেন্সর স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেন্সরগুলোতে ধারণ করা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বজ্রপাতের পূর্বাভাস তৈরি করা হবে। এ ছাড়া তালগাছ বজ্রপাত নিরোধক হওয়ায় সারা দেশে এই গাছের ১০ লাখ চারা রোপণের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এতে মোট ব্যয় হবে ১৭ কোটি টাকা। এর আওতায় ঢাকার আগারগাঁওয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় ছাড়াও ময়মনসিংহ, সিলেট, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, নওগাঁর বদলগাছি, খুলনার কয়রা, পটুয়াখালীর পুরোনো আবহাওয়া কার্যালয় এবং চট্টগ্রামে সেন্সর বসানো হচ্ছে। এসব যন্ত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা হয়েছে। সেগুলো আওতাভুক্ত এলাকার বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকানোর সমস্ত তথ্য ধারণ করে রাখবে। সেগুলো পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করে বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া সম্ভব হবে। আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ভূমিকম্পের মতো বজ্রপাতেরও পূর্বাভাস দেওয়ার সক্ষমতা তাদের নেই। এত দিন আকাশে মেঘের আনাগোনা থেকে কেবল বজ্রঝড়ের আভাস দেওয়া হতো। কিন্তু বজ্রঝড় থেকে কখন বজ্রপাত হবে তা জানা কঠিন। ফলে প্রতিবছর দেশে বজ্রপাতে বহু প্রাণহানি হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১৫ সালে বজ্রপাতে মারা যায় ২১৯ জন এবং চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২৪৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। মাঝে ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল আরও বেশি; ৩৮০ জন। ২০১৬ সালেই বজ্রপাতকে নতুন দুর্যোগ হিসেবে আওতাভুক্ত করে সরকার। এরপরই কেবল বজ্রপাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের নামসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহে রাখা হচ্ছে।

দুর্যোগ নিয়ে কাজ করে, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১১ সালের পর থেকে দেশে বজ্রপাতের আধিক্য বাড়তে শুরু করে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে প্রাণহানির সংখ্যা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্যোগ ফোরামের তৈরি এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৮৫ জন। ২০১২ সালে মারা যায় ২০১ জন। ২০১১ সালে তা ছিল ছিল আরও কম (১৭৯ জন)। অর্থাৎ প্রায় প্রতিবছরই বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে। আগে সাধারণত এপ্রিল-জুলাই মাসে বজ্রপাত হতো। গত পাঁচ বছরে এই অবস্থা বদলে গেছে। বিশেষ করে গত দু-তিন বছর জানুয়ারি মাসেও বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে এমনটি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মজিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যে ডিভাইস বসাচ্ছি, তা সার্বক্ষণিক কার্যকর থাকবে। তা সক্রিয় করার পর আমরা আওতাভুক্ত এলাকায় বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকানোর মাত্রা আগাম জেনে যাব।’ এই সেন্সরের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ১০-১৫ মিনিট আগে লোকজনকে সতর্ক করা সম্ভব হলেও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে আসবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডিভাইসগুলো এরই মধ্যে স্থাপনের কাজ চলছে। আগামী জুন পর্যন্ত আমাদের কার্যসীমা নির্ধারিত আছে। কিন্তু আশা করি তার আগেই আমরা এটা করে ফেলতে পারব।’ আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর আবহাওয়া বিভাগ এমন সেন্সরের সুফল পাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, ‘যন্ত্রটি চালুর পরই আমরা এর সুফল কতটা পাচ্ছি বুঝতে পারব। আর তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় লোকজনকে মুঠোফোনে খুদে বার্তা দিয়ে যদি আগাম সতর্ক করা যায়, তাহলে এই প্রযুক্তির সুফল পাওয়া গেলেও যেতে পারে। তবে আমাদের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আরও আধুনিকায়ন দরকার। সে ক্ষেত্রে বজ্রপাতের তথ্য সংগ্রহকারী সেন্সর সংযোজনকে একটি ধাপ বলা যায়।’