এলেন দেখলেন জয় করলেন

ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দুই ভাগ হওয়ার পর থেকেই মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা পোস্টারে পোস্টারে ছেঁয়ে দেয় রাজধানীর অলিগলি। তার এমন পোস্টার চোখে দেখেনি রাজধানীবাসী। সরব কোনো আয়োজনও ছিল না। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নাকি ফোন করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর সে নির্দেশনা আশীর্বাদ ছিল বলে একাধিক প্রোগ্রামে উল্লেখ করেছিলেন। আশীর্বাদ জেনে উন্নয়নের পথে এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। স্বপ্নজয়ের সিঁড়িতে ভর করেছিলেন সবে। স্থবির হয়ে পড়া রাজধানীর গতিও ফিরিয়েছিলেন খানিক। কিন্তু এই অবেলায় তার গতি থেমে যাবে, তা কে জানতো?

পেশীশক্তির রাজনীতিতে পা রাখেননি। নষ্ট রাজনীতির কাদা গায়েও লাগননি তিনি। বরং রাজনীতির নামে যারা অপরাজনীতি করছেন, তাদের জন্যও ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মেয়র আনিসুল হক। তার চলে যাওয়ায় কাদঁছেন নগরবাসী। কাঁদছেন অরাজনৈতিক-রাজনৈতিক মঞ্চের মানুষেরাও।

ভয়কে জয় করে উন্নয়নের মাঠ প্রসারিত করার নাম আনিসুল হক। যে দলের সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে জিতলেন, উন্নয়ন প্রশ্নে সেই দলের মানুষেরাই পথ আগলে ধরেন। অবরুদ্ধও হলেন। তবে নিরাশ হননি। সব বাধা পায়ে মাড়িয়েই স্বস্তি দিতে চেয়েছিলেন নগরে। দৃঢ় মনোবল আর সাহসিকতা দিয়েই তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের রাস্তা দখলমুক্ত করেছিলেন। দায়িত্ব নেয়ার দুই বছরেই ঢাকা উত্তরের রূপ বদলে দেন। সততা আর সাহসিকতার জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন নানা মহলের।

মেয়র আনিসুল হকের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল সিটি কর্পোরেশন কেন্দ্রিক টেন্ডার বাণিজ্য বন্ধ করে ক্রয় খাতে স্বচ্ছতা আনা। তাতে সক্ষমও হয়েছিলেন। আর তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ, গাবতলীতে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা এবং সর্বশেষ দূতাবাসপাড়ায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা তার যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়।

সদ্য প্রয়াত এই মেয়রের আরও কিছু সফল পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে নগরীর সৌন্দর্যবর্ধন ও সবুজায়ন; উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ; সড়কবাতি স্থাপন, সড়ক ও ফুটপাত নির্মাণ, সংস্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা, জলাবদ্ধতা নিরসনে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা।

ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নানা রংবেরঙের বিলবোর্ড সরানো ছিল যে কোনো মেয়রের জন্য চ্যালেঞ্জ। রাস্তার পাশে, ভবনের ছাদে কিংবা দেয়ালে হাজার হাজার বিলবোর্ড শহরের সৌন্দর্য ম্লান করে দিয়েছিল। সেই চিরচেনা রূপ বদলে দিয়েছিলেন আনিসুল হক। প্রায় ২০ হাজার বিলবোর্ড অপসারণ করে তিনি। গাবতলী আর আমিনবাজারের অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ করে গতি দিয়েছিলেন এখানকার সড়কে।

আনিসুল হকের আমলেই চলন্ত সিঁড়ি দেখতে পেলেন রাজধানীবাসী। গত দুই বছরে দুটি চলন্ত সিঁড়িসহ ৫৫টি ফুট ওভারব্রিজ, দুটি আন্ডারপাস এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে। ১০টি উন্নতমানের আধুনিক পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে, যা সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ব্যবহার করতে পারবে।

উন্নত নাগরিকসেবার জন্য ‘নগর’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ চালু হয়েছে তার সময়ই। নিরাপদ ঢাকা গড়ার প্রত্যয়ে এরই মধ্যে ৬৪২টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এতে জননিরাপত্তা বেড়েছে বহুগুণ। নগরবাসীর দুর্ভোগ কমাতে তার এলাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষ বাস সার্ভিস ‘ঢাকা চাকা’ চালু করেন। উত্তরায় ৩২ হাজার গাছের চারা রোপণ করেন। আরও ১০ লাখ গাছের চারা লাগানোর পরিকল্পনা চলছে।

আনিসুল হক ৬৬টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ করেছিলেন, যেখান থেকে গড়ে প্রতিদিন দুই হাজার ৪০০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে সফলতার সিঁড়িতে হাঁটতে গিয়ে বারবার বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল মেয়র আনিসুল হককে। মোটেও সহজ ছিল না রাজনীতির আকাশে অরাজনীতিক এই ব্যক্তির কেতন উড়ানো। ‘ইচ্ছা থাকলেও নগরের উন্নয়ন করা যাচ্ছে না’ এমন অতৃপ্তির কথাও শুনিয়েছিলেন বারবার। তবুও থেমে থাকেননি। সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সহযোগিতাই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল বারবার।

এত স্বপ্ন নিয়েও মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন হস্যময়ী আনিসুল হক। তবে মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তিনি চিরঞ্জীব হয়ে বেঁচে থাকবেন নগরবাসীর মাঝে।