ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারকে ‘ফাঁকা বুলি’ বলছেন বিশ্লেষকরা

বাংলাদেশে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও গণফোরাম সহ ছোট কয়েকটি দল নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যে নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেছে, সেটা কতটুকু বাস্তবায়ন করা হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন দুর্নীতি বিষয়ক সংস্থা মুখপাত্র।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অঙ্গীকার করার সময় ভাল কথা বলা হয়, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সেসব অঙ্গীকার পূরণের নজির খুবই কম।

দুর্নীতি বিষয়ক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশানাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড: ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দল বিএনপির অতীতের দিকে তাকাতে হবে।

”তাদের অতীতের ট্র্যাক রেকর্ড অনুযায়ী বলা যায় যে এগুলো ফাঁকা বুলির বাইরে বেশি কিছু ভাবা কঠিন।,” ড: ইফতেখারুজ্জামান বলেন।

তিনি বলছেন দৃষ্টান্তস্বরূপ বলেন, ২০০৮এর নির্বাচনের আগে বিএনপির সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল যে ক্ষমতায় গেলে তারা সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি বন্ধ করে দেবে।

”অথচ সেইসময়ই সবচেয়ে বেশি সংসদ বর্জন হয়েছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে। এবং সেটা তারাই করেছিলেন,” তিনি বলেন।

ঐক্য ফ্রন্টের তাদের ইশতেহারে ১৪টি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবার অঙ্গীকার।
  • দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার লক্ষ্যে বিধান তৈরি।
  • সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা কমিয়ে নারী প্রার্থী মনোনয়নের সংখ্যাবৃদ্ধি।
  • নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা।
  • গত ১০ বছরের মামলা, গুম, খুন, বিচারবর্হিভূত হত্যা তদন্তে সত্যানুসন্ধান ও বিভেদ নিরসন কমিশন গঠন করে খোলা মনে আলোচনা করে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সমাধান করা।

ঐক্যফ্রন্ট তাদের অঙ্গীকারে বলেছে “গত দশ বছরে কল্পনাতীত স্বেচ্ছাচারিতা এবং পুলিশকে দলীয় ক্যাডার হিসাবে ব্যবহার করে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা, গুম, খুন , মামলার ঘুষ বাণিজ্য ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় লক্ষ লক্ষ পরিবার ক্ষুব্ধ ও বিপর্যস্ত। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী ও আইনজীবী সম্বন্বয়ে সর্বদলীয় সত্যানুসন্ধান ও বিভেদ নিরসন (ট্রুথ অ্যাণ্ড রিকনসিলিয়েশন) কমিশন গঠন করে খোলামনে আলোচনা করে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান করা হবে।”

শুধু গত ১০ বছর কেন?

ড: ইফতেখারুজ্জামান বলছেন ট্রুথ অ্যাণ্ড রিকনসিলিয়েশনের বিষয়টি সাধারণত গঠন করা হয় কোন দেশে গৃহযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায়ি।

সেখান থেকে এই ধারণাটি নেওয়া হলেও তিনি প্রশ্ন তুলছেন, “শুধু বিগত দশ বছর কেন? গুম, অপহরণ, হত্যা এগুলো তো দশ বছরের আগেও হয়েছে বাংলাদেশে। তাহলে এই বিষয়টা কেন একপাক্ষিক হবে?”

“আর দ্বিতীয়ত এসব অপরাধ কি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য? এখানে তাহলে ন্যায়বিচারটা কোথায় যাবে?”

তিনি বলছেন এই অপরাধগুলো এমন নয় যে এগুলো ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। “তাহলে কি বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে এখানে একটি বিশেষ দল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জড়িত বলে সেখানে একটা নমনীয় হবার প্রচেষ্টা বা বার্ত দেয়া হচ্ছে, নাকি তারা সত্যিই বিষয়টা নিয়ে ট্রুথ অ্যাণ্ড রিকনসিলিয়েশন করতে চান!”

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মির্জা তসলিমা সুলতানা বলছেন তারা যে একটা সত্যানুসন্ধান কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন সেটাকে তিনি স্বাগত জানান।

তিনি বলছেন, গুম, খুন যেগুলো হয়েছে, এবং বিচারবহির্ভূত যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো নিয়ে তো কোন না কোনভাবে রিকনসিলিয়েশন (আপোষ) করতে হবে।

”নাহলে সবসময় প্রতিহিংসার যে পরিস্থিতিটা বিরাজমান, সেটা আরও বাড়বে। আমার মতে সত্য অনুসন্ধানের একটা পথ আমাদের খোলা রাখতে হবে, ” মিজ সুলতানা বলেন।

তবে তিনি বলছেন সেটার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কীনা, সেটা নির্ভর করবে তারা ক্ষমতায় গেলে কাদের নিয়ে এই কমিশন গঠন করবেন তার উপর।

তিনিও ড: ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে একমত যে গত ১০ বছরের আগে যদি বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন হয়ে থাকে, সেটা তাদের এড়ানোর চেষ্টা উচিত হবে না।

দুর্নীতি দমন নিয়ে সন্দেহ

দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে।

ড: ইফতেখারুজ্জামান বলছেন বিএনপির আগের মেয়াদে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে তাতে এই অঙ্গীকার কতটা বাস্তবায়িত হতে পারে তা নিয়ে “সন্দেহ থেকেই যায়”।

“২০০৪-এ ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপি যে কমিশন গঠন করেছিল একটা আইনের উপর ভিত্তি করে, সেই আইনটা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু কমিশনের নেতৃত্বে তারা এমন মানুষকে বসিয়েছিল, তা ছিল এক অর্থে দলীয় বিবেচনায় এবং দুই তারা যেন কিছু করতে না পারে সেই বিবেচনায়।”

তিনি বলছেন এই কমিশন গঠনের পেছনে নাগরিক সমাজ, বেসরকারি সংস্থা এবং দাতা সংস্থাগুলোর একটা ভূমিকা ছিল। তারপরেও এক অর্থে দলটি অঙ্গীকার রক্ষা করলেও, ওই কমিশনের মেয়াদে সংস্থাটি দুর্নীতি দমনে কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে পারে নি। “কাজেই ট্র্যাক রেকর্ড দেখলে এসব কথা শুনতে যতই ভাল লাগুক না কেন, বাস্তব বিবেচনায় এখান থেকে খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা করা কঠিন।”

তবে মির্জা তসলিমা সুলতানা বলছেন, শুধু দুর্নীতি দমন কমিশন নয়, রাষ্ট্রের যতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোকে তার আইনত চলতে দিতে হবে।

“অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। অতীতে তারা ইশতেহারে দেয়া অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন যে করেনি, সেটার ফল কী হয়েছে, সেটা তো দলটি দেখছে। কাজেই অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান ইশতেহারের বাস্তবায়ন তারা ক্ষমতায় গেলে কীভাবে করবে তা তাদের ভাবতে হবে।”

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার রূপরেখা কী হবে তা স্পষ্ট করেনি।

ড: ইফতেখারুজ্জামান বলছেন তাদের এই প্রস্তাবটি ইতিবাচক কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান এখন সাংবিধানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে।

জোটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সব অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনকালীন সরকারের একটা চরিত্র নির্ধারণ করতে চায় তারা।

“এটা করতে পারলে ভাল,” এই মত পোষণ করে ড: ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “কিন্তু যখন ক্ষমতায় বসবেন তারা এই যে একটা অ্যাকোমোডেটিভ অ্যাপ্রোচ (আপোসকালীন দৃষ্টিভঙ্গি) যেটার কথা এখন বলা হচ্ছে- প্রতিটা অঙ্গীকারের সঙ্গে যে কথাগুলো জুড়ে দেয়া হয়েছে- যেমন আলোচনা সাপেক্ষে বা সকলের মতামত সাপেক্ষে- এই মনোভাবটা কতখানি থাকবে সেটা কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।”

তিনি বলছেন ক্ষমতায় বসে তারা তাদের ১৪ দফা প্রতিশ্রুতির কতটা ডেলিভারি করতে পারবেন সেটাই বড় প্রশ্ন। “অতীতে বিভিন্ন কমিটি অকার্যকর হওয়ার মূল কারণ স্বার্থের দ্বন্দ্ব।” “অতীতের ইশতেহারগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে দেখবেন মোটা দাগে পুরনো অনেক প্রতিশ্রুতিই আবার করে বলা হয়েছে – এবার কিছুটা পরিশীলিত ভাষায় এবং আধুনিকায়ন করে।”

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মেয়াদ দুটিতে সীমিত করার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন দুজন বিশ্লেষকই।

ড: ইফতেখারুজ্জামান বলছেন শেষ পর্যন্ত এমনটা যেন না হয় যে “কোন না কোন কারণে এটা বাস্তবায়ন না করলে কী আসে যায়?”

মির্জা তসলিমা সুলতানা বলছেন, “মূল ইস্যুটা হল দলে গণতান্ত্রিক চর্চা চালু রাখা, গণতান্ত্রিক চর্চা চালু থাকলে নেতৃত্বের পরিবর্তন নিয়ম অনুযায়ীই হবে। এটা ভাল প্রস্তাব।” এবং এটা তারা বাস্তবায়ন করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।-বিবিসি বাংলা