কতটা অত্যাধুনিক ছিল হকিংয়ের চেয়ার

১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্মেছিলেন জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। ২১ বছর বয়সে মোটর নিউরন রোগ ধরা পড়ার পর থেকেই হুইলচেয়ারই তার জীবনের প্রধান অনুসঙ্গ হয়ে যায়। তবে তার হুইলচেয়ার বিশ্বের আর পাঁচটা মানুষের ব্যবহার করা হুইলচেয়ারের মত নয়। অত্যাধুনিক এ চেয়ারের মাধ্যমেই তিনি অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন।

এই চেয়ারের সঙ্গে যুক্ত ছিল কম্পিউটার আর তার মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক সফটওয়্যার। পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে গেলেও এসব সফটওয়্যারের মাধ্যমে কথা বলতেন তিনি।

২১ বছর বয়স থেকেই কথা অস্পষ্ট হয়ে যায় হকিংয়ের। আর একেবারে কথা বন্ধ হয়ে যায় ১৯৮৫ সাল থেকে। সে বছর সার্নের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে জেনেভায় গিয়েছিলেন হকিং। হঠাৎই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে ট্রাকিওকটমি (গলায় গর্ত করে তার ভেতর দিয়ে উইন্ডপাইপ ঢুকিয়ে দেওয়া) করতে হয়। এরপরই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি।

বাকশক্তি হারানোর পর বানান লেখা কার্ড ব্যবহার করে কথা বলা শুরু করেন খ্যাতিমান এই পদার্থবিজ্ঞানী। এক-এক করে বর্ণ লিখে নিজের কথাগুলো বলতেন। এটা ছিল অনেক ধৈর্যের কাজ। এছাড়া চোখের চাহনিতে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, কী বলতে চান।

হকিংয়ের এমন কষ্ট দেখে তার পদার্থবিদ বন্ধু মার্টিন কিং গোপনি যোগাযোগ করেন ক্যালিফোর্নিয়ার সংস্থা ‘ওয়ার্ডপ্লাস’ এর সঙ্গে। তারা ‘ইকুয়ালাইজার’ নামে একটি প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছিল, সেখানে হাতে রাখা যন্ত্রে ক্লিক করে কম্পিউটারের মাধ্যমে শব্দ বা কথা বোঝানো যায়।

হকিংয়ের জন্য ‘ইকুয়ালাইজার’ এর সঙ্গে যুক্ত করা হল ‘স্পিচপ্লাস’ নামে একটি সংস্থার তৈরি যন্ত্র ‘স্পিচ সিন্থেসাইজার’। হুইলচেয়ারের একটি হাতলে লাগিয়ে দেওয়া হল সেটি। হাতের ইশারায় যন্ত্রের মাধ্যমে কম্পিউটারে লেখা হতো। আর সিন্থেসাইজার মারফত ভেসে উঠল সেই কথা।

এক মিনিটে ১৫টি পর্যন্ত যান্ত্রিক শব্দ প্রকাশ করতে পারতেন হকিং। এতে তার প্রথম বলা কথাই ছিল “এক জন সহকারী দরকার, ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ শেষ করতে হবে’।”

এভাবেই এক দশকেরও বেশি সময় কাটানোর পর ১৯৯৭ সালে হকিংয়ের সঙ্গে দেখা হয় ‘ইনটেল’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরের। তিনি হকিংকে মাইক্রোপ্রসেসর যুক্ত ইনটেলের আসল কম্পিউটার ব্যবহারের আহ্বান জানান। তিনি সে আহ্বানে সাড়া দিলে তারপর থেকে হকিংকে যাবতীয় প্রযুক্তিগত সাহায্য দিত ইনটেল। প্রতি দু’বছর অন্তর তার কম্পিউটার বদলে দিত তারা। এভাবে বেশ কিছু বছর চলার পর ২০০৮ সালে হাতে যে সামানো সাড়া দেয়ার শক্তি ছিলো সেটাও চলে গেলো। সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে গেল তার শরীর। তখন তার সহকারী নতুন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। ইনফ্রারেড রশ্মির সাহায্যে কাজ করা ‘চিক স্পিচ’ নামের এ যন্ত্রটি হকিংয়ের চশমার সঙ্গে লাগানো হয়। আর এ যন্ত্রের অপর অংশ সফটওয়্যারসহ লাগানো হয় তার গালে।

এতদিনে তার মাথাও একদিকে বেঁকে গিয়েছে। আর গালের একপাশ সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে। তখন শুধু গালের একটিমাত্র পেশি কাজ করে। ওই গালের একপাশের পেশির কম্পনই পড়ে ফেলতে পারতো ‘চিক স্পিচ’ নামের সফটওয়্যারটি।

তবে ২০১১ সালে এসে গালের একপাশের পেশিও নাড়াচাড়া বন্ধ করে দেয়। সর্বশেষ মিনিটে মাত্র দুটি শব্দ বলতে পারতেন হকিং। তখন তিনি ইনটেলের ‘ইনটেল’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরকে লেখেন, ‘কথা বলার গতি কমে গিয়েছে। আপনার সংস্থা কি সাহায্য করতে পারে?’

এরপর হকিং এর ৭০তম জন্মদিনে ইনটেলের গোটা ল্যাবই নিয়ে আসা হয় ক্যামব্রিজে। অনেক চেষ্টার পরও হকিং এর কথা বলার শক্তি বৃদ্ধি করতে পারেনি তারা। তাদের ব্যর্থতার পর হকিং বলেন, ‘মানুষের মস্তিষ্ক হল আসল কম্পিউটার। যখন ওর অংশগুলো খারাপ হয়ে যাবে, কম্পিউটার কাজ করা থামিয়ে দেবে। ভাঙা কম্পিউটার কি পুনর্জীবন পায়? না স্বর্গে যায়?”

এ বিস্ময় কিংবদন্তিকে ২১ বছর বয়সেই ডাক্তাররা বলেছিলেন দুই বছরের মধ্যে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে তাকে। তবে ডাক্তারদের ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে সম্পূর্ণ অকেজো শরীর আর প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে তিনি বহু পথ পাড়ি দিয়েছেন। দিয়েছেন আধুনিক বিজ্ঞানকে বদলে দেওয়ার মত একাধিক তথ্য।