কবি চেতনায় মৃত্যু ভাবনা || নাজমীন মর্তুজা

আমার ইংরেজি ভাষায় দখল টা পোক্ত নয় বলে মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে একটা দৈন্য অনুভব করি, কিন্তু প্রকৃতির ভারসাম্য অপার, আমি যে দেশে বাস করছি সেখানে ইংরেজি ভাষার দখল… পাখিরাও গান গায় ইংলিশে ঝিঁ ঝিঁ ডাকে ইংলিশে, মৌমাছি গুন গুন করে ইংলিশে, এরা সব্বাই আমাকে ইংরেজি লিরিক কানে ভরে দেয় বলে মাতো মাতো আমাদের মত কথা বলো গান গাও কবিতা লিখো, এতো কিছুর মধ্যে হঠাৎ আমার চেতনায় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল কয়েকটা শব্দ, আমার এত দিনের শোনা শব্দ সমস্ত অভিজ্ঞতা দেখা ও দর্শন ঘন হয়ে এসে রূপ নিলো কবিতার লাইনে। জানি না যে কথা বলতে চাই লিখতে চাই তা লিখা হবে কিনা, হয়ত হবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর, হয়ত অন্তিমে গিয়ে লিখতে পারবো গোটা কতক লাইন, জানি কবিতা শুধু আবেগ জাগানো নয়, কবিতা হলো অভিজ্ঞতা। একটি কবিতা লিখবার জন্য কত কষ্ট পেতে হয়, কত ব্যথা বইতে হয়, কত কত শহর, কত কত মানুষ, কত বস্তু জানতে হয়, কত জীবের কর্ম, কত ফুল ফোটা ঝরে যাওয়া, পাখির উড়াল, নদীর বাঁক , সাগরের ঢেউ গুনতে হয়, কত কত অবহেলা অনাদর, কত কত প্রত্যাখ্যান কত কত সমবেদনা, সয়ে তার হয়ত লিখা হয় কয়েকটি মহত কবিতা। প্রকৃতি দেয় মহত কবিতা লিখবার প্রসাদ। তখন কবি নিজেকে বোঝাতে পারে’ আমি ন্যূনতম মানুষ নই, যারা আমাকে অবহেলা করে তাদের থেকে নিচু নই। একটা পৃথিবী গড়ে তোলেন কবি, আমাদের অজ্ঞাতেই আমরা এগিয়ে যাই তার দিকে। বলেছিলেন স্টিভেন্স তাঁর “The Necessary Angel “কবি বলেছিলেন আমাদের ভেতরকার এই পৃথিবী যদি না থাকতো, তবে মিথ্যে হয়ে যেত আমাদের চারদিকে বাইরের এই পৃথিবী, আরো বলেছিলেন ঈশ্বরে বিশ্বাস ছেড়ে দেবার পর মানুষ তার মুক্তি খুঁজে পায় কবিতার সারাৎসারে। কবি তখন হয়ে উঠেন অদৃশ্যের যাজক। মাল্টে, রিলকে ওয়ালেস স্টিভেন্স রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে তাদের কবিতা নিয়ে তুলনামূলক কিছু লিখবার জন্য একটা সাবজেক্ট মাথায় কুলবুল করছে বহুদিন ধরে, সময়ের অভাবে লিখতে পার ছিনা বলে মাঝে মাঝে বমি বমি ভাব হয়, মনে হয় আর তো ভেতরে রাখতে পারছি না বাইরে বেরুবার পথ খুঁজছে।

এই জীবন এবং জীবন ব্যপী কর্ম এবং মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা যাকে দেবদূত বলে আহবান জানানো হয় কবিতার ভাষায়, শুধু স্টিভেন্স, রবীন্দ্রনাথ, মাল্টে, রিলকে নয় আমরা লালন, শাহ আব্দুল করিম, কিংবা হাসনরাজার গানেও দেবদূতের আহবান পেয়ে থাকি । জীবনে র শেষ প্রান্তে এসে সবাই যেন কার অপেক্ষায় বসে থাকি, স্টিভেন্স ভিন্ন দেশে বসে লিখেছেন এক দেব দূতের কথা যিনি এসে বলবেন ‘I am the angel of reality’ স্বাগতম টাঙানো আছে যে দরজায় সেখানে এসে কি পৌছাবে না কেউ? মূহুর্তের জন্য দেখা যায় এই angel কে তারপর আবার উধাও, সব শূন্য, – আমারই দেখায় তুমি দেখো, আমারই শোনাই তুমি শোন বলেন সে দেবদূত । বড় ক্ষণিক তাঁর অস্তিত্ব, মনের খোলা দরজার সামনে অল্প সময়ের জন্যই এসে দাঁড়ান , ‘seen for a moment standing in the door! এই লাইন গুলোর মধ্যে একটা অপেক্ষা পাই, কিংবা চলাচলের এই ছবিতে আমরা রবীন্দ্রনাথের লাইন গুলো মনে করতে পারি – চকিতে চলে যাওয়া তাঁর রাজার দুলালের কথা, তাঁর খেঁয়া বা গীতাণ্জলীর কনো কনো কবিতা। আক্ষরিক না হলেও প্রতীকের তাৎপর্য আছে, মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না… তেমন কিছু প্রতিকী শব্দ পাই লালনের গানে, লালন রিল্ কে রবীন্দ্রনাথ বা স্টিভেন্স এই সব ছবির মধ্য দিয়ে আমাদের পৌঁছে দিতে চান এক অন্তর্গত সত্যের ধারণায়। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি আমাদের প্রকৃতিতে; আমাদের আকাঙ্খা যোগ্যতা আমাদের ভাবনা আর কাজ আমাদের আদর্শ আর বাস্তব মিলতে চায় না কোনো সামন্জস্যে। কিন্তু কোন এক শক্তি নেই বা মুহুর্ত মধ্যে দৃশ্যে- অদৃশ্যে ভিন্নতা লোপ করে দিতে পারে , দৃশ্যের মধ্যে এনে দিতে পারে অদৃশ্যের দ্যুতি। দৃশ্য জগত কেই আমরা একান্ত সত্য ভেবে জড়িয়ে থাকতে চাই বলে, এই দৃশ্যাতীতের আহ্বান কাঁপিয়ে তোলে না আমাদের , সহজে আমরা সইতে পারি না তার আর্বিভাব।

রিলকে বলেছেন..আমরা কেবল আমাদের প্রস্তুত করে রাখতে পারি , বহু যত্ন করে ধুয়ে মুছে রাখতে পারি, মনের মাঝখানে একখানা ঘর, যাতে অপচীয়মান মুহুর্তের মধ্যে হঠাৎ কখনো ছুঁয়ে যেতে পারি অন্তহীনকে। রিলকের মতে এই প্রস্তুতিই হলো ভালোবাসা, এই প্রস্তুতিই হয়ে – ওঠা। দৃশ্য আর অদৃশ্যের এই ভাবনাই অনিবার্য ভাবে আমাদের পৌছে দেয় জীবন আর মৃত্যুর ভাবনায়।

এই সব কবিদের কবিতা ভাবনায় দর্শনে আমি চিন্তার খেই হয়ত মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলেছি অনেক খানে কিন্তু ঘুড়ি কাটা সুতো আবার আঙুলে জড়িয়ে তাদের ভাবনায় জুড়েছি নিজেকে, এই যে আমরা সাধারণ মানুষ দুই বাধা বন্ধন হারা দেশের অধিবাসী, আসলে কি এপার বলে কিছু আছে? ওপার বলে কিছু আছে? মৃত্যু হলো জীবনের চলমান এক স্তর, সেভাবে দেখলে বুঝলে, মানুষ তার মৃত্যুর অভিজ্ঞতাকে নিজেরই অন্ন্তর্গত বলে জানতে পারে একদিন।