কমছে ঢাকার আসন সংখ্যা

একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এবার শুধু জনসংখ্যার উপর ভিত্তি না করে জনসংখ্যা, ভোটার সংখ্যা এবং সংসদীয় এলাকার পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে সীমানা পুনঃনির্ধারণের কথা ভাবছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই প্রক্রিয়ায় জনসংখ্যা, মোট আয়তন ও ভোটার সংখ্যাকে প্রাধান্য দিয়ে ঢাকাসহ বড় বড় শহরের আসনসংখ্যা কমানোর চিন্তা করা হচ্ছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো যোগ করা হবে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে।

এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসির চূড়ান্ত করা রোডম্যাপে বলা হয়েছে, ‘সময়ের পরিবর্তনে এবং জনগণের শহরমুখী প্রবণতার কারণে বড় বড় শহরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যার আধিক্য অথবা ঘনত্ব বিবেচনা করা হলে শহর এলাকায় সংসদীয় আসন সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে পল্লী অঞ্চলে আসন সংখ্যা কমে যাবে।’

‘ফলে শহর এবং পল্লী অঞ্চলের সংসদীয় আসনের বৈষম্য সৃষ্টির সুযোগ হবে। সীমানা নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় শুধু জনসংখ্যার উপর ভিত্তি না করে জনসংখ্যা, ভোটার সংখ্যা এবং সংসদীয় এলাকার পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে সীমানা নির্ধারণ করার জন্য আইনি কাঠামোতে সংস্কার আনা প্রয়োজন। কেননা ভোটার তালিকা প্রতিবছর হালনাগাদ করা হয়। জনসংখ্যা, মোট আয়তন ও ভোটার সংখ্যা উভয়কে প্রাধান্য দিয়ে বড় বড় শহরের আসনসংখ্যা সীমিত করে দিয়ে আয়তন, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও উপজেলা ঠিক রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ বিষয়টি কমিশনের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে’ এতে যোগ করা হয়।

রোডম্যাপে বলা হয়, ‘নতুন সৃষ্ট প্রশাসনিক এলাকা এবং বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণের প্রয়োজন হবে।’

এতে আরো বলা হয়েছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে সমগ্র দেশে প্রত্যক্ষ নির্বাচনভিত্তিক ৩০০ সংসদীয় আসনের কথা উল্লেখ রয়েছে। Delimitation of Constituencies Ordinance, 1976 (Ordinance No. XV of 1976) অনুযায়ী প্রতিটি জাতীয় সংসদ সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে সীমানা নির্ধারণের কাজ সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে প্রচলিত আইন অনুসারে বিগত আদমশুমারির জনসংখ্যার ঘনত্বের ভিত্তিতে এই সীমানা নির্ধারণের কাজটি করা হয়ে থাকে। এ বিষয়ে প্রশাসনিক অখণ্ডতা বজায় এবং যাতায়াত সুবিধার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ভোটার সংখ্যা ও আয়তনের বিষয়টি আইনে গুরুত্ব পায়নি।’

নির্বাচন কমিশনের নথিপত্র থেকে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০০১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে নির্বাচনী এলাকার সীমানার ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২০১১ সালে একটি আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২০১১ সালের আদমশুমারির উপর ভিত্তি করে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণে দৃশ্যমান তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। অর্থাৎ ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রায় সকল ক্ষেত্রে ২০০৮ সালে অনুসৃত নির্বাচনী সীমানা বলবৎ রাখা হয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে ২০১১ সালের আদমশুমারির প্রকাশিত প্রতিবেদন বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে নির্বাচনী এলাকাগুলোর সীমানা উপর্যুক্ত অধ্যাদেশের ধারা ৬ এর উপ-ধারা (২) অনুসারে প্রশাসনিক সুবিধা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, আয়তন এবং জনসংখ্যার বিভাজনকে যতদূর সম্ভব বিবেচনায় রেখে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণে কাজ করা সমীচীন হবে বলে এতে বলা হয়।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ মোটামুটি একই পদ্ধতিতে হয়। ২০০৮ সালে সীমানা নির্ধারণে জনসংখ্যার ঘনত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন কমিশন দশম সংসদ নির্বাচনের আগে জনসংখ্যার বিভাজনকে তেমন প্রাধান্য না দিয়ে ছয় নীতি অনুসরণে সীমানা পুনঃনির্ধারণ করে। প্রতিটি জেলার ২০০৮ সালের মোট আসনসংখ্যা অপরিবর্তিত রাখা, আগের নির্ধারিত সীমনা যতদূর সম্ভব বহাল রাখা, সংসদীয় আসনের এলাকা অন্য জেলায় সম্প্রসারণ না করা, যতদূর সম্ভব উপজেলা অবিভাজিত রাখা, ইউনিয়ন/সিটি/পৌর ওয়ার্ড বিভাজন না করা এবং জনগণের যাতায়াতের সুবিধা অনুসরণ করা হয়।

এবার আসন্ন সংলাপে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের মতামতকে প্রাধান্য দিয়েই সীমানা পুনঃনির্ধারণের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।

এদিকে ইতোমধ্যে বিএনপি সিইসির সঙ্গে সাক্ষাত করে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের সীমানায় ফিরে যাওয়ার সুপারিশ করেছে। পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা জনসংখ্যা ও ভোটার সংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।

সীমানা পুনঃনির্ধারণের দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে জানান, জনসংখ্যা, ভোটার ও আয়তন এই তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে এবার সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা হবে। সীমানা পুনঃনির্ধারণের জন্য আইন সংশোধন করে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে।

তিনি বলেন, আইন সংশোধন করা না গেলে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে আসন সীমিত করে গ্রামাঞ্চলের আসন বাড়ানো হবে। কারণ ঢাকা শহরে জনসংখ্যা অনেক বেশি হলেও এসব নাগরিকদের মধ্যে বেশিরভাগই গ্রামের ভোটার। তাই সীমানা পুনঃনির্ধারণের মাধ্যমে গ্রাম এবং শহরে সমতা আনতে চাই। এতে হয়তো সব রাজনৈতিক দলকে সন্তুষ্ট করা যাবে না তবে জনগণের কল্যাণে যুক্তিসঙ্গতভাবে সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা হবে।

রোডম্যাপ অনুযায়ী, কমিশন জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সংলাপ করবে। আগস্ট থেকে সীমানা পুননির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।

বর্তমানে দেশে সোয়া ১৫ কোটি জনসংখ্যা রয়েছে। এরমধ্যে ভোটার রয়েছে ১০ কোটি ১৮ লাখেরও বেশি। সেক্ষেত্রে প্রতি আসনে গড়ে ৫ লাখেরও বেশি জনসংখ্যা ও ৩ লাখ ৪০ হাজারের মতো ভোটার সংখ্যার কম-বেশিকে বিবেচনায় কাজ করতে হবে।

সীমানা পুনঃনির্ধারণ কর্মপরিকল্পনা

জুলাই-আগস্ট: নির্বাচনী এলাকা পুনঃনির্ধারণে নতুন নীতিমালা প্রস্তুতকরা।

আগস্ট: জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমস বিশেজ্ঞদের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত।

অক্টোবর: নীতিমালার আলোকে বিশেষজ্ঞদের কারিগরি সহায়তায় ৩০০টি আসনের সীমানার খসড়া তালিকা প্রণয়ন।

নভেম্বর : ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার খসড়া তালিকা প্রকাশ করে দাবি/আপত্তি/সুপারিশ আহ্বান।

নভেম্বর-ডিসেম্বর: দাবি/আপত্তির বিষয়ে অঞ্চল ভিত্তিক শুনানি শেষে নিষ্পত্তিকরণ। এবং

ডিসেম্বর: ৩০০টি আসনের সীমানা চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।