কাতার নিয়ে উল্টো চাপে সৌদি আরব

কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করার পর এখন অনেকটাই উল্টো চাপের মুখে পড়েছে সৌদি নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় দেশগুলো। বলা যায়, বড় ধরনের কূটনৈতিক পরাজয় ঘটেছে এসব দেশের।

কাতারের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে দেশটিকে একঘরে করার প্রচেষ্টা শুধু ব্যর্থই হয়নি; সৌদি আরবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান উপসাগরীয় আরেকটি দেশেও প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে। একই সাথে কাতারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্ক সেনা পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

তুরস্কের পার্লামেন্ট সেনা পাঠানোর অনুমোদন দেয়ায় কাতারে সৈন্য পাঠানো শুরু হয়েছে। কাতারের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় এই সেনা পাঠানো হচ্ছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এ সমস্যা সমাধানের সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন এই অবরোধ অমানবিক ও অনৈসলামিক।

অন্য দিকে, কাতার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সৌদি আরব সফর করেছেন।

উপসাগরীয় দেশগুলোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক দুনিয়া থেকে কাতারকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। এ পর্যন্ত কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে মাত্র ৯টি দেশ। এগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর, ইয়েমেনের সৌদি অনুগত সরকার, লিবিয়ার একাংশের সরকার, মালদ্বীপ, মৌরিতানিয়া ও সেনেগাল।

এর মধ্যে কয়েকটি দেশে কার্যকর সরকার নেই। অবশ্য সৌদি আরবের এসব পদক্ষেপে নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। অপর দিকে, সরাসরি কাতারের পাশে দাঁড়িয়েছে ইরান ও তুরস্ক। অন্য প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলো এ ধরনের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। কাতারকে বিচ্ছিন্ন করার এই প্রচেষ্টা সমর্থন করেনি ইরাক। দেশটি বলছেÑ সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কাজ সমর্থন করে না দেশটি।

সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন দেশগুলো ধারণা করেছিল কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের ফলে দেশটি খাদ্য সঙ্কটে পড়বে এবং ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এর ফলে শেষ পর্যন্ত কাতার দাবি মেনে নিয়ে সৌদি আনুগত্য স্বীকার করে নেবে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কাতার সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছেÑ দেশটিতে খাদ্য সঙ্কটের কোনো সম্ভাবনা নেই। ইরান ও তুরস্ক থেকে যেমন খাদ্য পাঠানো হচ্ছে, তেমনি জিসিসির আরেক সদস্য ওমান থেকে নৌপথে খাদ্যের জাহাজ কাতারে যাচ্ছে। সর্বশেষ মরোক্ক ঘোষণা দিয়েছে দেশটি কাতারে খাদ্য পাঠাবে।

অপর দিকে, ফিফার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এখন পর্যন্ত কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন সম্ভব হবে না এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।

কাতারের ওপর অবরোধ নিয়ে সৌদি আরবের জন্য সবচেয়ে হতাশাজনক দিক হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫ জুন অবরোধ আরোপের পর টুইট করে এই অবরোধকে সন্ত্রাসবাদ দমনে তার বিশাল সাফল্য হিসেবে দাবি করলেও এখন পর্যন্ত তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে পথে হাঁটেননি।

ট্রাম্পের সাথে পেন্টাগনের অবস্থানেরও যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। সর্বশেষ মার্কিন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জানিয়েছেন কাতারের সাথে আরব দেশগুলোর এই বিরোধে মিলিটারি অপারেশনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিম ম্যাটিস বলেছেন, কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের এই ঘটনা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। সবাই মিলে এক সাথে বসে এর সমাধান করা উচিত।

মার্কিন কর্মকর্তাদের এ ধরনের অবস্থান সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর সন্ত্রাসে মদদদানে কাতারের বিরুদ্ধে অভিযোগকে গুরুত্বহীন করে তুলছে। এই অবরোধকে কাতারের ওপর বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি বলেছেন, কেন এই অবরোধ আরোপ করা হয়েছে তা এখনো আমরা জানি না। তিনি বলেন, কাতার কারো নির্দেশান মেনে চলবে না। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এর মধ্যে তিনি রাশিয়া, ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। পশ্চিমা দেশগুলো কাতারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পরিবর্তে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের তাগিদ দিয়ে আসছে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাতারের ওপর অবরোধ আরোপে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন।

এই অবরোধ আরোপের ফলে এক দিকে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসির) মধ্যে যেমন ভাঙন দেখা দিয়েছে; তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর ইমেজ ক্ষুণœ হচ্ছে। কাতার সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে সৌদি নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর এ অভিযোগের চেয়ে অবরোধ আরোপের আইনগত ও মানবিক দিক নিয়ে চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে। ফলে সৌদি অবস্থানে কিছুটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবাইর বলছেন, কাতারের ওপর কোনো অবরোধ আরোপ করা হয়নি। শুধু সৌদি আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন কাতারের ভাইরা বিষয়টিকে আন্তর্জাতিকরণ করেছে। কিন্তু তারা শিগগিরই দেখবে এর সমাধান সৌদি বাদশাহ সালমানের হাতে।

শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নয় আরব জনমতও এ ধরনের অবরোধ আরোপের বিপক্ষে। হামাস ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দেয়াকে সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দেয়া বলে মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে যেসব অভিযোগ ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে তাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

কারণ ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হিসাবে তুলে ধরা আরব জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। অপর দিকে, মুসলিম ব্রাদারহুড আরব বিশ্বে সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল। দলটিকে যেভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে বাস্তবতার সাথে আরব জনগণ মিল খুঁজে পাচ্ছে না। সরকারের অবস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষের সমালোচনা ঠেকানোর জন্য আরব আমিরাত আইন করেছে কাতার, হামাস বা মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থনে বক্তব্য রাখলে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করলে কারাদণ্ড প্রদান করা হবে। এ ধরনের আইন এসব দেশের দুর্বল অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ।

সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত কাতারের সাথে সমাঝোতায় আসতে হবে। আর এই সমাঝোতার উদ্যেগটি নিতে হবে সৌদি আরবকে।

ইতোমধ্যে কুয়েতের মধ্যস্থতায় সমঝোতা প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। অনেক বিশ্লেষক মনে করেনÑ একটি ক্ষুদ্ররাষ্ট্র কিভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বড় ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রকে মোকাবেলা করতে পারে কাতার সঙ্কট তার উদহারণ হয়ে থাকবে।