কাশ্মীর হামলা : কী ঘটতে যাচ্ছে পাক-ভারতের মধ্যে

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বৃহস্পতিবার এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়।

প্যামপোর শহরে ভারতের আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের বহন করা একটি বাসের ওপর বিস্ফোরকবোঝাই একটি গাড়ি ধাক্কা দিলে অন্তত ৪৪ সেনা নিহত হয়েছেন। এতে আরও বেশ কজন আহত হন।

ভারতের সামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে কাশ্মীরের বিদ্রোহীদের সহিংসতা নতুন কিছু না। তবে এবারের ঘটনা একেবারে ভিন্ন। গত কয়েক দশকের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতী হামলা।

হামলার পর নড়েচড়ে বসেছে ভারত। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশী পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে এ হামলার কঠোর জবাব দেয়ার হুমকি দিয়েছেন।

মূল সমস্যা আসলে এখানেই। কারণ কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এর আগেও কয়েক দফা যুদ্ধ হয়েছে। আর দুদেশের সীমান্তে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ তো লেগেই আছে।

কাশ্মীরের এই হামলা কী দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে শত্রুতাকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যাবে? এটাই এখন বিশ্লেষকদের মূল প্রশ্ন।

হামলার জন্য দায়ী কে

বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম) হামলার দায় স্বীকার করেছে। মূলত তারা কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়।

হামলাস্থলের কাছাকাছি একটি শহর থেকে আসা আদিল ধর নামের এক ব্যক্তি এ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন বলে জানিয়েছে জেইএম। কাশ্মীরের জন্য এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা না। সম্প্রতি সেখানে ইসলামিক উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোতে তরুণদের যুক্ত হওয়ার হার বাড়ছে।

কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির বরাতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, ২০১৭ সালে ১২৬ তরুণ জঙ্গি গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছেন। ২০১৬ সাল ও তার পরের বছরে সেখানে তরুণদের উগ্রপন্থায় যুক্ত হওয়ার হার ৪৪ শতাংশ বেড়েছে।

কাশ্মীর উপত্যাকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারবিরোধী ক্ষোভ ও তিক্ততা আরও গভীর হয়েছে। বিশেষ করে ভারত সরকার সেখানে সহিংস দমনমূলক কৌশল বেছে নিলে কাশ্মীরিদের ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়।

গত বছর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীরে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সমন্বিত তদন্তে ভারত সরকারের উচিত এইচআরডব্লিউয়ের সঙ্গে কাজ করা।

জেইএম হামলার দায় স্বীকার করায় পরিস্থিতি আর অস্থিতিশীলতার দিকে যাবে। কারণ পাকিস্তানভিত্তিক এই সংগঠনটি খুবই অত্যাধুনিক ও ভারতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ইতিহাস আছে যাদের।

২০০১ সালে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে পার্লামেন্ট ভবনে ও পাঠানকোটে বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায় জেইএম।

পাকিস্তানে সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ হলেও সেখান থেকেই গত দুই দশক ধরে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা। এতে করে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আভাস পাওয়া যায়।

পাকিস্তানি তালেবানের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামাবাদকে সহায়তাও করছে জয়শ-ই-মোহাম্মদ।

জাতিসংঘে সংগঠনটিকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাইলে চীন তাতে কয়েকবার ভেটো দিয়েছে।

নিষিদ্ধ সত্ত্বেও ইসলামাবাদ তাদের সমর্থন দিয়ে আসছে বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। ভারত ও তার বাইরেও অনেকে প্যামপোর হামলার ঘটনায় পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর সমর্থন রয়েছে বলে ধারনা করছে।

ইসলামাবাদ সবসময় এমন অভিযোগ অস্বীকার করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।

পাকিস্তান হয়তো হামলাকারীদের আন্তঃসীমান্ত সংশ্লিষ্টতা নিয়ে একটি তদন্ত করবে এবং এসময়ে জইশ-ই-মোহাম্মদের বেশ কয়েকজন নেতাদের আটক করবে।

তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, চলমান বৈরিতায় এ ধরনের হামলার তদন্তে পাকিস্তান সাড়া দিতে অস্বীকার করবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় কী ঘটতে যাচ্ছে

শুক্রবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ হামলার জোরালো প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু হামলার ঘটনায় পাকিস্তানভিত্তিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে ভারতের কৌশলগত উভয়সংকট নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে। তা হচ্ছে, পারমাণবিক যুদ্ধ ছাড়া কীভাবে প্রতিশোধ নেয়া সম্ভব।

এ নিয়ে ভারত সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গেই কাজ করতে হবে। ভারতের মাটিতে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন জানানোয় পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিজ্ঞা করে আসছেন মোদি।

চলতি বছরে ভারতে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এতে তীব্র ভোট যুদ্ধের আভাস পাওয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে মোদিকে বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে।

গত বছরে ভারতের পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে ব্যাপক পরাজয়ের শিকার হয়েছে নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ভিপিন নারাং ও পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, পাকিস্তানের প্রতি ক্ষোভের মতো কোনো পররাষ্ট্রনীতিই ভারতীয় ভোটারদের একজায়গায় করতে পারে না। যদি এ হামলার ঘটনায় মোদি সরকার কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তবে ঘরোয়া রাজনীতিতে তাদের মারাত্মক খেসারত দিতে হবে।

কী পদক্ষেপের কথা ভাবছে ভারত

২০০১ ও ২০০২ সালে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা পাকিস্তানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্তে ব্যাপক সেনা সমাবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তখন সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দেয়া হয়েছিল দেশটির পক্ষ থেকে।

সীমান্তের উরি শহরে সামরিক ক্যাম্পে সশস্ত্র হামলার জবাবে ২০১৬ সালে ছোট আকারে আক্রমণ চালানোর দাবি করেছিল ভারত।

পাকিস্তাননিয়ন্ত্রীত কাশ্মীরে পাকিস্তানি সামরিক এবং গোয়েন্দা অবস্থানে বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনীর হামলা চালানোর কথাও বিবেচনা করেছিল ভারত। এছাড়া পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে বড় আকারের ক্ষিপ্র হামলার পরিকল্পনাও ছিল ভারতীয় বাহিনীর।

কিন্তু প্রতিবেশী দেশের এ ধরনের কিছু উদ্যোগ প্রতিহত করে দিতে পারে পাকিস্তান। কারণ কাশ্মীরে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা অবস্থান অনকূলে। এতে ভারতের পূর্ণমাত্রার হামলার ক্ষয়ক্ষতি সীমিত করে দিতে পারবে পাকিস্তানি বাহিনী।

ইসলামাবাদ ২০০১ সালে সীমান্তে ভারতের বড় ধরনের সেনা সমাবেশের পাল্টা জবাব দিয়েছিল সেনা মোতায়েন করেই।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান ছোট আকারে যুদ্ধক্ষেত্র পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যেটাকে কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র নামে ডাকা হয়।

সেক্ষেত্রে অগ্রগামী বাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতের বড় ধরনের হামলার ঘটনায় এ অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে পাকিস্তান। এতে ভারতের যেকোনো পদক্ষেপের ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে।

সবমিলিয়ে পরমাণু অস্ত্রসমৃদ্ধ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বৈরিতার তীব্রতা প্রশমনের নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এখানে এমনটা বলা হচ্ছে না যে ভারত এতে একেবারে দমে যাবে।

ভারতের অনেক নীতিনির্ধরকসহ তাদের সেনাপ্রধানের যুক্তি হচ্ছে, পাকিস্তানের সক্ষমতা বর্ণনার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। যদিও বেশ কিছু কর্মকর্তা বলছেন, পাকিস্তানের পাল্টা আঘাত নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

এ অবস্থায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে সুবিধা পাচ্ছেন মোদি। তিনি সম্ভবত এসব অনিশ্চয়তার কথা মাথায় রাখছেন। সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের ঝুঁকির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক খেসারতের কথা মূল্যায়ন করছেন তিনি। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের শক্তিপ্রয়োগের আশঙ্কা বাস্তবিক বলা যাবে।

মার্কিন ভূমিকা কী হবে

বৃহস্পতিবারের হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু দেশটি এখন এক অদ্ভূত অবস্থায় রয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে, দীর্ঘ ১৭ বছরের আফগান যুদ্ধের অবসানে পাকিস্তান তাদের সহায়তা করুক।

সাম্প্রতিক সময়ে আফগান শান্তি আলোচনায় পাকিস্তানের সহায়তার সতর্কভাবে প্রশংসা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সেনাপ্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মার্কিন আঞ্চলিক নীতিতে পাকিস্তানের গুরুত্ব বেড়েছে।

কাজেই পাকিস্তানের মাটি থেকে আসা সন্ত্রাসবাদের দায়ে দেশটির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ কঠিন হয়ে পড়ছে। এতে পাকিস্তানে ভারতীয় সামরিক অভিযানে সমর্থন দিতেও পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। তবে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ স্বর্গ পরিণত হওয়ায় পাকিস্তানের অব্যাহত নিন্দা জানিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তা হবে ভারতকে সমর্থনের মার্কিন সম্ভাব্য মাত্রা।-ওয়াশিংটন পোস্ট