কী বার্তা দিয়ে গেলেন সুষমা স্বরাজ

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফর ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে সম্পর্কের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। তারা বলেন, এ সফরে আরেকবার প্রমাণ হল, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত অধিক গুরুত্ব দেয়। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সুষমার ভূমিকা ইতিবাচক। তাছাড়া বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তার এ সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এ সফরে স্পষ্ট যে, আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রতি ভারতের তীক্ষ্ণ নজর থাকবে। এছাড়া দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যুতে অগ্রগতি আনতে এ সফরের বেশ গুরুত্ব রয়েছে।

সুষমা স্বরাজের সফরকে খুবই ফলপ্রসূ বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক। তিনি সোমবার বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফর খুবই সফল হয়েছে। এ সফরের ফলাফলে আমরা সন্তুষ্ট। সার্বিক বিবেচনায় এ সফর খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে।’ রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সুষমার ভূমিকা সম্পর্কে অভিমত চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সফর থেকে যে ফল পাওয়া গেছে, তাতে আমরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট।’

পররাষ্ট্র দফতরের সংশ্লিষ্ট অপর এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা এ সফর থেকে যতটা প্রত্যাশা করেছিলাম, ঠিক ততটাই ফল এসেছে। প্রাপ্তিতে কম কিংবা বেশি নেই। এটা বলা যায়, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নির্ধারিত পথেই অগ্রসর হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে ভারতের নিজস্ব নীতির মধ্যে থেকে যতটুকু সমর্থন তারা দিচ্ছে, সেটা সন্তোষজনক।’

বাংলাদেশ-ভারত চতুর্থ ‘জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন’ (জেসিসি) বৈঠকে যোগদানের লক্ষ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ রোববার ঢাকায় আসেন। জেসিসি বৈঠকে পানিবণ্টন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সীমান্ত সমস্যাসহ সার্বিক দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে আলোচনা হয়। তবে সবার আগ্রহের বিষয় ছিল রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সুষমা স্বরাজ কী বার্তা দেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশা করা হয়েছিল, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ভারত যেন তার অবস্থানকে আরও সুসংহত করে। সুষমা স্বরাজ রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণ না করে ‘বাস্তুচ্যুতদের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানো’ হলেই শুধু স্বাভাবিক অবস্থা ফিরবে বলে মন্তব্য করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে এ মন্তব্যে বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সুষমা স্বরাজ। তাদের মধ্যে একান্ত আলোচনাও হয়েছে। জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। বৈঠক হয়েছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুষমার। এসব বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে- এমনটায় দাবি সূত্রগুলোর। তবে কার্যত কী আলোচনা হয়েছে, সেটি জানা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত নির্বাচনের সময় ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের ভূমিকার ব্যাপারে বিএনপি নাখোশ ছিল। সে কথা ইঙ্গিতে সুষমাকে বলেছেন বিএনপি নেতারা। এর জবাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল রাখতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতি সুষমা স্বরাজ জোর দিয়েছেন বলে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন।

সুষমা স্বরাজের সফরের ফল সম্পর্কে জানতে চাইলে ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার আহমেদ তারেক করিম সোমবার বলেন, ‘তিন বছর পর জেসিসি বৈঠক হওয়ায় খুব ভালো হয়েছে। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় জেসিসি বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকের অগ্রগতি দুই পক্ষই মূল্যায়ন করেছে বলে আমি মনে করি। এটা থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আরও ইতিবাচক কিছু হবে বলে আশা করি।’

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গেই আমাদের কূটনীতি করতে হবে। আজকাল সবাই ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। আমাদেরও দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। সুষমা স্বরাজ রোহিঙ্গা শব্দ বলেননি বলে কেউ কেউ সমালোচনা করছেন। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে যারা এসেছেন, তাদের ফেরত নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। রোহিঙ্গা শব্দ বলা না বলাটা এখানে প্রাসঙ্গিক কিছু নয়।’

আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সুষমার সফরকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে তারেক করিম বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, পাকিস্তানসহ ৬-৭টি দেশে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো আঞ্চলিক প্রভাব ফেলে। সেই দিক থেকে ভারত আমাদের নির্বাচনের প্রতি নজর রাখবে, এটা স্বাভাবিক। আমরাও তাদের ‘নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ’ নিয়ে দেখব। তবে আমার আশা থাকবে, ভারত আমাদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে না।’ সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার হেমায়েত উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে মিল রেখে যদি একটা দৃঢ় ভূমিকা নেয়া যায়, তবে তার থেকে ভালো কিছু আশা করা যায়। আমি মনে করি, এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে নিশ্চয় কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। এটা হয়ে থাকলে তা খুব ভালো হবে।’

ভারতে বাংলাদেশের আরেক সাবেক হাইকমিশনার লিয়াকত আলী চৌধুরী বলেন, ‘সুষমা স্বরাজের সফর থেকে এটা স্পষ্ট যে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে খুবই গুরুত্ব দেয়। ফলে এদেশে ভবিষ্যতে আস্থাভাজন লোকেরা দায়িত্বে থাকে কিনা, সে ব্যাপারে তাদের আগ্রহ থাকবে। ফলে এখানে কী ঘটছে, সেটা নিশ্চয় ভারত নিবিড় পর্যবেক্ষণ করবে।’

রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চীন যে অবস্থান নিয়েছে তাতে এটি একটি কঠিন সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ভারত এ ব্যাপারে সতর্ক অবস্থানে থাকবে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের সঙ্গেও তারা থাকবে। আবার এ সংকট নিরসনে মিয়ানমারকে খুব যে চাপ দেবে, এমনটা মনে হয় না।’