কেন অন্যের সন্তান গর্ভে ধারণ করছে ভারতের নারীরা?

অর্থের বিনিময়ে অন্যের সন্তানকে নিজের গর্ভে ধারণ করেন যারা তাদের বলা হয় সারোগেট মা। সন্তান জন্মদানের জন্য তাদের গর্ভ ভাড়া নেয়া হয়। আবার যারা ডিম্বানু বিক্রি করে তাদের বলা হয় ‘ডিম্বানু দাতা বা ডোনার’। এ বাণিজ্যটি আমাদের দেশে দেখা না গেলেও ভারতে এটা অহরহ হচ্ছে। যদিও এ ব্যবসাকে অমানবিক বলে দেখছে দেশটির আদালত।

কোনো সন্তানহীন বা বন্ধ্যা দম্পতি অথবা কোনো একক মা বা বাবা সন্তানলাভের জন্য সারোগেট মায়ের গর্ভ ভাড়া নেন। এক্ষেত্রে ‘সারোগেট মা’ বা যিনি সেই সন্তান ধারণ করছেন, এতে তার সম্মতি থাকতে হবে। সন্তানটি প্রসবের পর সারোগেট মা সদ্যজাত সন্তানকে ওই দম্পতির কাছে দিতে বাধ্য থাকেন। এছাড়াও, এই প্রক্রিয়াটিতে ‘ডিম্বানু দাতা’ খুঁজতে হয়। মেডিকেল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন নারীর জরায়ু থেকে ওই ডিম্বানু বের করে আনতে হয়, এজন্য সময় লাগেলে কম পক্ষে এক মাস।

তেমনি একজন ‘ডিম্বানু দাতা’ ভারতের মুম্বাইয়ের সাহেদা খান (২৬)। গত মার্চে কেরেলার একটি ফরটিলিটি ক্লিনিকে ২০ দিন ধরে আছেন। প্রতিদিনই তার শরীরে হরমন ইন্জেকশন করা হচ্ছে। এভাবে ত্রিশ দিন পর তার জরায়ু দিয়ে ডিম্বানু বের করা হবে। এই প্রক্রিয়াটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় আইভিএফ বলা হয়। ওই ক্লিনিকে সাহেদার মত অনেক নারীই আছে যাদের ‘ডিম্বানু দাতা’ বলা হয়। এত সবের পর সাহেদা পাবেন ৪৫ হাজার রুপি। এই টাকা দিয়ে সাহেদা নিজের এক ছেলে ও মেয়েকে মাদরাসায় লেখা পড়া করাচ্ছেন।

বিশ্বব্যাপী এখন আইভিএফ পদ্ধতি নিঃসন্তান দম্পতি, একক মা কিংবা বাবাদেও কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে ১৫ বিলিয়ন ডালার মূল্যেও আইভিএফ মেশিন বিক্রি হয়েছে। পরিচয় গোপন করার সত্তে¡ চেন্নাইয়ের এক ডাক্তার বলেছেন, ‘ডোনার থেকে যে ডিম্বানু নেওয়া হয় তা আইভিএফ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চুড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়।’

আইভিএফ মার্কেট থেকে শুধু ভারতেই বছরে ১ হাজার ৭০ কোটি রুপি আয় হয়। ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সালে গিয়ে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ২ হাজার ৬ শ কোটি রুপি।

তবে দুঃখের খবর হলো এই প্রক্রিয়াটি ওই সব সারোগেট মায়েদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে তাদের শরীরে মরণব্যধী ক্যানসার বাসা বাঁধতে পারে। ভারতের অধিকাংশ সারোগেট মা হলেন গরীব পরিবারের তাই তাদের ভালো চিকিৎসারও সুযোগ নেই। তাছাড়া এর বিনিময়ে তারা খুব বেশি টাকাও পায় না। তারা ডিম্বানু বিক্রি ও অন্যের সন্তান গর্ভে ধারণ করে সংসার চালায়।

স¤প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে ওষুধ খেয়ে শরীরে উত্তেজনা তুলে যে ডিম্বানু ওইসব মায়েদের জরায়ু থেকে বের করা হয় এই প্রক্রিয়ার ফলে তারা জীবনের ঝুঁকিতে রয়েছে। অথচ এসব সারোগেট মায়েরা তা জানে না। ভারতের ক্রোল.ইন তাদের জিজ্ঞেসা করলে তারা জানান এসব তারা কিছুই জানে না। আর ওই সব ক্লিনিকও তাদের এ সম্পর্কে ধারণা দেয় না।

ফারটিলিটি ক্লিনিকগুলো সাধারণত তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে ‘ডিম্বানু দাতা’ ও সারোগেট মা খুঁজে আনে। আবার কিছু কিছু বন্ধা কাপল সারোগেট মা খুঁজে নিয়ে ক্লিনিকগুলোতে আসে। আবার কেউ ক্লিনিকের মাধ্যেমে ওই সব মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

সব সারোগেট মায়ের গর্ভের মূল্য বেশি নয়। কারণ এক্ষেত্রে অনেক পরিবারই চায় সারোগেট মা শিক্ষিত হোক, তাদের আইকিউ ভালো হোক এর ওপর নির্ভর করে গর্ভের দাম হয়। কেননা, যার আইকিউ ভালো বা শিক্ষিত তার গর্ভের সন্তানও ভালো হবে। এ ক্ষেত্রে সাহেদার চাহিদা দক্ষিণ ভারতে বেশ।

ডোনার থেকে এজেন্ট- সাবিত্রি

৩৭ বছর বয়সী সাবিত্রি, যিনি সাহেদা খানকে ডোনার করেছেন। পূর্ব পরিচিত সাহেদাকে ২০১০ সালে প্রথম ডোনার হওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন সাবিত্রি। যেহেতু তিনি এ কাজে প্রায় পাঁচ বছর পার করেছেন, তাই তাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি সাহেদা। তাকে রাজি করে প্রথমে সাহেদার স্বামীকেও রাজি করেন। সাবিত্রি বলেন, ‘প্রথমে কারো পরিবার তাকে এ কাজ করতে দিতে চায় না। কারণ তারা মনে করে সারোগেট মা হতে মনে হয় অন্য কারো শয্যাসঙ্গী হতে হয়। পরে ভুল ভাঙালে তারা রাজি হয়।’

সাবিত্রও ২০০৫ সালে সারোগেট মা হিসেবে কাজ করতো। এক সময় তার ছেলে তার মাকে মাঝে মাঝেই অন্তঃসত্ত্বা হতে দেখে জিজ্ঞাসা করতো, লজ্জায় ওই কাজ ছেড়ে দিয়ে। সারোগেট মা খোঁজার কাজে লেগে যান। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও পাঁচ বার এই কাজ (সারোগেট মা হওয়া) করেছি।’

এরই মধ্যে প্রায় ১০০ জন ‘সারগেট মা’ এই ক্লিনিকে নিয়োগ দিয়েছেন সাবিত্রি। এর মাধ্যমে তিনি সেখান থেকে কমিশন পান। তিনি বলেন, কিছু কিছু ডাক্তার সারোগেট মা ও ডোনারদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। তাদের কোনো চ্যারিটি ফান্ড নেই।’

ভারতে প্রথম সারোগেসি বাণিজ্যিকভাবে চালু করেন ডা. নয়না প্যাটেল। আহমেদাবাদ থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে আনন্দ শহরে ২০০৫ সালে বাণিজ্যিকভাবে এই কার্যক্রম শুরু করেন। সেসময় থেকেই নিঃসন্তান দম্পতিদের কাছে ডা. নয়না প্যাটেল এক বিশ্বস্ত ও জনপ্রিয় নাম হয়ে ওঠেন।

এরপর আহমেদাবাদ এটা ছড়িয়ে পড়ে কলকাতা, দিল্লী ও মুম্বাই ওই চেন্নাইয়ে। এখানে পশ্চিমা দেশগুলো থেকেও খদ্দের আসে। সূত্র: স্ক্রোল.ইন, টাইমস আব ইন্ডিয়া এবং ডয়েচে ভেলে।