কেন আত্মহত্যাপ্রবণ কলকাতার অভিনেত্রীরা

টলিউডের অভিনেত্রী পায়েল চক্রবর্তী সম্প্রতি আত্মহত্যা করেছেন। এ আত্মহত্যা একটা বিতর্ক উসকে দিলো। অভিনেত্রীদের আত্মহত্যার যে হিড়িক পড়েছে, তার জন্য দায়ী কি বদলে যেতে থাকা সমাজ, নাকি ব্যক্তিগত প্রত্যাশা পূরণের চাপ?

লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের গ্ল্যামার জগতে নিছক একজন বা দু’জনের আত্মহত্যার ঘটনা নয়, তালিকা দিন দিন বাড়ছে। পায়েল চক্রবর্তীর আত্মহত্যার আগে গত তিন বছরেই মৌমিতা সাহা, বিতস্তা সাহা, দিশা গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মহত্যা সংবাদের শিরোনামে এসেছে। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাইরেও পাওয়া গেছে এমন সংবাদ।

মুম্বাইয়ে প্রত্যুষা গঙ্গোপাধ্যায়, অঞ্জলি শ্রীবাস্তব বা বিদিশা বেজবরুয়ার আত্মহত্যার ঘটনা স্তম্ভিত করেছে দর্শকদের। সিনেজগতের এ মুখগুলো সাধারণ মানুষের কাছে অচেনা নয়। তারা অভিনেত্রী। অভিনয়কে পেশা করার সুবাদে আমজনতা তাদের রোজনামচায় আগ্রহ রাখেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে এমন কি ঘটে থাকতে পারে যে, শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথই বেছে নিতে হয়েছে? শুধুই কি ব্যক্তিগত জীবনের চাওয়া-পাওয়া, নাকি রূপালি পর্দার অমোঘ আকর্ষণের পিছনে থাকা মানসিক অবসাদের গ্রাসে তলিয়ে গেছেন তারা?

নিঃসন্দেহে মানুষের বিনোদনের বদল ঘটে গেছে। বিপ্লব ঘটেছে বাঙালির জীবনযাত্রায়। চ্যানেলের সংখ্যার মতো বেড়েছে মেগা সিরিয়ালের সংখ্যাও। পেশাগত ক্ষেত্রে পারিশ্রমিকের পাশাপাশি কাজের সুযোগও যে বেড়েছে সে ব্যাপারে শিল্পীরা একমত।

‘চেকমেট’, ‘মা’ ও ‘সাত পাঁকে বাঁধা’সহ অনেক জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করা মানসী সিন্হা বললেন, চ্যানেলও যেমন বেড়েছে, তেমনি কাজ অনেক বেড়েছে। মেগা সিরিয়ালের পাশাপাশি ওয়েব সিরিজেও সুযোগ বেড়েছে। আর্টিস্ট ফোরামের সদস্যের সংখ্যা ২ হাজার ৭০০। তার মানে শিল্পী-কলাকুশলীর সংখ্যাও বেড়েছে। কাজের জোগান আছে বলেই আর্টিস্টের সংখ্যা বাড়ছে।

সত্যিই কি তাই? তাহলে ব্যান্ডেলের মৌমিতা সাহা সুইসাইড নোটে কেন লিখেছিলেন, আমার আর অভিনেত্রী হওয়া হলো না? সেটা কি কাজ না পাওয়ার আক্ষেপ, নাকি কাজের চাপ সামলাতে না পারার অবসাদ? এর গভীরে ঢুকতেই চোখ রাখতে হবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে।

সম্প্রতি বাংলা সিরিয়াল প্রচারে ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিল বিনোদন চ্যানেলগুলো। বকেয়া পারিশ্রমিকের দাবিতে কেবল নয়, সিরিয়ালের কাজ বন্ধ ছিল অনেক কারণে। বাংলা সিরিয়ালের শিল্পী সংগঠন বা আর্টিস্ট ফোরামের অভিযোগ অনুযায়ী, এসব সিরিয়ালে গভীর রাত পর্যন্ত শ্যুটিং চলে। কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে না। এতে অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত শিল্পীদের পারিবারিক জীবন বলে কিছু থাকে না।

এ বিষয়ে আর্টিস্ট ফোরামের সম্পাদক অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, আমরা প্রযোজকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে কাজের সময়সীমা কমিয়ে এনেছি। এখন রাত ১০টার মধ্যে প্যাক-আপ হয়ে যাওয়ায় বাড়ির লোকেদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছি। এতে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসছে।

পরিবার যে মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- এ ব্যাপারে সহমত প্রকাশ করলেন মনোচিকিৎসক কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, এমনিতে গ্ল্যামার জগতের মানুষদের নার্সিসাস কমপ্লেক্স (নিজেকে বেশি ভালোবাসা) থাকে। তারা মনে মনে খুব নিঃসঙ্গও। তারপর কাজের লাগামছাড়া চাপে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব বা কাছের মানুষের থেকে দূরত্ব কিন্তু একজনের কাছে খুবই হতাশাজনক হয়ে উঠতে পারে।

কাজের চাপ যে কারও আত্মহত্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে, এ কথা মানতে নারাজ অভিনেত্রী সৌমিলী বিশ্বাস। তার মতে, কাজের চাপ যদি আত্মহত্যার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে তো বড় বড় শিল্পীরা অনেক আগেই আত্মহত্যা করতেন। কাজের চাপ চিরকাল ছিল এবং থাকবে। সেটা তো সব জীবিকাতেই আছে।

অসংখ্য মেগাসিরিয়ালের প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ও একই সুরে বললেন, অভিনয় পেশা শুধু টাকা দিচ্ছে না, দিচ্ছে সম্মান, খ্যাতি। তাই সে সবের কথা মাথায় রেখে কাজের চাপটা নিচ্ছে সবাই।

তার দাবি, বিশ্বায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে আত্মহত্যা বেড়েছে। অভিনেত্রীদের পরপর এ আত্মহত্যা কোনোভাবেই টেলিভিশন পাড়ার কাজের চাপের সঙ্গে জড়িত নয়। তাদের মধ্যে এটা মিল শুধু যে তারা অভিনয় করতেন। প্রযোজক হিসেবে বাংলা সিরিয়ালের শ্যুটিংয়ের সম্প্রতি সময়সীমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমনিতে ১৪ ঘণ্টা সময়টা শ্যুটিংয়ের জন্য যথেষ্ট। এখন রাত ১০টা পর্যন্ত শ্যুটিং হচ্ছে। অসুবিধা হচ্ছে না তো।

লীনা গঙ্গোপাধ্যায় আরো বলেন, প্রত্যেকদিন অনেক ছেলেমেয়ে আসে, তারা অভিনয় করতে চায়। প্রশিক্ষণ, যোগ্যতা, গ্রুমিং, প্রতিভা ছাড়াই তারা রূপালি পর্দায় নামী হতে ইচ্ছুক। কাজেই চাহিদা বা জোগানের ভারসাম্য থাকবে না। নিজেকে তৈরি না করে শুধু রূপালি জগতের হাতছানিতে এলে ডিপ্রেশন তো বাড়বেই।