কেন যুদ্ধের সক্ষমতা হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?

খুব আগেকার কথা নয়, ১৯৫১ সালে মার্কিন পতাকাবাহী বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৮৮টি। কালের পরিক্রমায় এখন সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮১টিতে।

আর এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কেনেথ ওয়াইকেল মনে করিয়ে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যেকোনো দেশের সঙ্গে নতুন করে যুদ্ধে জড়ানো কঠিন হবে।

কেনেথ ওয়াইকেল ছিলেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর ট্রান্সপোর্টেশন কমান্ডের কমান্ডার। তার দায়িত্ব ছিল মার্কিন সামরিক বাহিনীর সকল অংশের অর্থাৎ সেনা, নৌ, বিমান ও মেরিনবাহিনীর লজিস্টিকস বিষয়গুলোর দেখভাল।

‘ডিফেন্স নিউজ’ ম্যাগাজিনে সাম্প্রতিক এক লেখায় কেনেথ ওয়াইকেল মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিশ্বের কোথাও কোনো যুদ্ধে জড়াতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে যে পরিমাণ রসদ পরিবহন করতে হবে, বাস্তবে সে পরিমাণ মার্চেন্ট মেরিন জাহাজ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রু হাতে নেই। দেশটির মার্চেন্ট মেরিনে বর্তমান ১৮শ’ ক্রু ঘাটতি রয়েছে। এর অর্থ জাহাজ যোগাড় করা সম্ভব হলেও তা নিজস্ব ক্রু দিয়ে চালানোর অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিটাইম সি-লিফট কমান্ড এবং মেরিটাইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের হাতে এখন রয়েছে ৬১টি জাহাজ, যা তারা যেকোনো জরুরি দরকারে ব্যবহারের জন্য রেখেছে। এর মধ্যে ২৬টা আবার সনাতনি স্টিম ইঞ্জিনে চলে, যা এখনকার দিনে চালাতে গেলে নানা ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। এসব জাহাজের বেশকিছুর বয়স ৫০ থেকে ৬০ বছর, যা তাদের চলাচলের সক্ষমতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে।

এ ধরনের জাহাজ চালাতে গেলে মাঝসমুদ্রে যেকোনো ধরনের বিপাকে পড়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে জাহাজের কমতির চাইতে বড় সমস্যা হলো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রু’র অভাব।

মার্কিন কংগ্রেসের কাছে পেশ করা মেরিটাইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এক রিপোর্টে দেখা যায়, মার্কিনীদের জরুরি দরকারে ‘স্টোর’ করে রাখা ‘রেডি রিজার্ভ ফোর্স’র জাহাজগুলো চালাতে তাদের হাতে রয়েছে ১১ হাজার ৭৬৮ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেরিনার। কিন্তু, তাদের দরকার হবে ১৩ হাজার ৬০৭ জন।

প্রয়োজনের চাইতে কমসংখ্যক ক্রু থাকায় জরুরি দরকারে তাদের সমুদ্রে বেশি সময় থাকতে হবে। আর বেশি সময় সমুদ্রে থাকলে ক্রুদের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাবে, ভুলের পরিমাণ বাড়বে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ পৌঁছাতে অনেক দেরি হবে।

মার্কিন ‘মেরিটাইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’- এর প্রধান এডমিরাল মার্ক বুজবি বলেন, ‘মার্কিনীরা জাহাজ স্বল্পতায় পড়ার আগেই ক্রু’র স্বল্পতায় পড়বে।’

সদ্য অবসরে যাওয়া মার্কিন ট্রান্সপোর্টেশন কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল ড্যারেন ম্যাকডিউ সিনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটির সামনে বলেন, ‘জাহাজ এবং ক্রু’র অভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা-সম্পর্কিত কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের এই দুর্বলতা তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোও জানে এবং সময়মতো যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তি সহকারে হাজির হতে না পারাটা মার্কিন সামরিক বাহিনীকে ‘কাগুজে বাঘ’ (পেপার টাইগার)- এ পরিণত করবে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ডিটারেন্ট দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।’

ইউএস মার্চেন্ট মেরিন একাডেমি থেকে এক সময় প্রতি বছর ৩৫০ জন মিডশিপম্যান বের হতেন। সেই সংখ্যা বেশ কিছু বছর আগেই কমে ২৭০ জনে ঠেকেছে।

জেনারেল কেনেথ ওয়াইকেলের মতে, মার্কিন প্রশিক্ষণ অবকাঠামো এখনো বেশ ভালোই বিদ্যমান আছে। তবে একে ব্যবহার করে নতুন ক্যাডেট প্রস্তুত করাটা সহজ নয়। কারণ, এজন্য অতিরিক্ত বাজেট যোগাড় করাটা কঠিন। আর বাজেট থাকলেও সমস্যা হবে জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো নিয়ে। নিজস্ব বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা বেশি থাকবে যখন নিজস্ব জাহাজে মালামাল পরিবহন বেশি হবে।

মার্কিন মেরিটাইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এডমিরাল মার্ক বুজবির মতে, মালামাল পরিবহন বাড়াতে হলে মার্কিন সরকারকে শতভাগ পণ্য মার্কিন জাহাজে পরিবহন করতে হবে। এটি করলেই কেবল মার্কিন বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

বুজবির মতানুসারে, সিদ্ধান্ত নেয়া খুব সহজ নয়। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে চীন, ইইউ এবং অনান্য দেশের পণ্যের প্রবেশাধিকার বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের শতভাগ বাণিজ্য পণ্য মার্কিন জাহাজে পরিবহন করার চেষ্টা নতুন করে বাণিজ্য প্রতিযোগিতার জন্ম দিতে পারে।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর লজিস্টিকস নিয়ে সমস্যা নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘গভর্নমেন্ট বিজনেস কাউন্সিল’- এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের সামরিক লজিস্টিকস খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে।

৩শ’ বর্তমান পররাষ্ট্র দফতর এবং সামরিক পোশাকে কর্মরত কর্মকর্তাদের মতামতের ভিত্তিতে করা সেই সার্ভে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশ কর্মকর্তার মনে করেন, লজিস্টিক্যাল সমস্যার কারণে মার্কিন সামরিক বাহিনীর যুদ্ধপ্রস্তুতি ব্যাহত হচ্ছে। এর মাঝে ২৫ শতাংশ আবার বলেছেন, সমস্যাটা খুব খারাপ অবস্থানে চলে গেছে।

মার্কিন বর্তমান এবং প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে বার্তাসংস্থা ‘রয়টার্স’ও এক প্রতিবেদনে একই ধরনের সমস্যার কথা বলেছিল।

৮০ শতাংশ কর্মকর্তা বলছেন, তাদের সামরিক ইউনিটে রসদের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। অথচ একইসঙ্গে বহু রসদ অদরকারি হওয়ায় তা অবহেলায় পড়েছিল।

এর বাইরেও লজিস্টিক্যাল সমস্যার ফিরিস্তি শেষ হবার নয়। ২০১৭ সালের শুরুতে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়াকে মাথায় রেখে সামরিক মহড়ার সময় মার্কিন সেনাবাহিনীর ৫টি ট্যাঙ্ক জার্মানির ব্রেমারহ্যাভেন বন্দরে বেশ কিছুদিন ধরে আটকে থাকে। কারণ, কর্তৃপক্ষ ঠিক করতে পারছিল না কিভাবে এগুলোকে পোল্যান্ডে মহড়ার জন্যে পাঠানো যায়।

২০১৫ সালে রোমানিয়াতে এক সামরিক মহড়ার সময় আবিষ্কার করা হয়, সেখানকার সেতুর উপর দিয়ে সাঁজোয়া যান যেতে পারবে না। এছাড়া মহড়ার সময় আবিষ্কার করা হয়, সাঁজোয়া যানের ব্যাটারি চার্জ করা ছিল না বা জ্বালানি কম থাকায় সেগুলো চালানো যাচ্ছিল না।

ইউরোপে মার্কিন সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল বেন হজেস বলেন, ‘এক সময় মার্কিন সেনারা জানতেন এই ভুলগুলো কিভাবে এড়ানো যায়। এখন সে ধরনের লোকও নেই।’

ফলে সামরিক বিশ্লেষকরা স্পষ্টই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্র দিনকে দিন তার সামরিক সক্ষমতা হারাচ্ছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে এসেছে, চাইলেও বা বাধ্য হলেও কোথাও কোনো যুদ্ধে জড়াতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে সাতবার ভাবতে হচ্ছে।