কৌশলী আওয়ামী লীগের সামনে সতর্ক বিএনপি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এখনও প্রায় দেড় বছর। এতোটা সময় সামনে রেখে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনী প্রস্ততি নিতে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে নির্বাচনমুখী বিএনপি ঘোষণা না দিলেও ‘সংগোপনে’ নির্বাচনের প্রস্ততি শুরু করেছে। তবে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই দলেরই পরস্পরবিরোধী অবস্থান। একদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। অন্যদিকে বিএনপি ‘সহায়ক’ সরকারের অধীনে আাগামী নির্বাচনের দাবিতে এখনও ‘অনড়’।

বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি নির্বাচনের প্রস্ততি নিলেও এখনই জানান দিতে চায় না। আগে থেকে ঘোষণা দিলে বিএনপির মনোভাব জেনে যাবে সরকার ফলে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের ব্যাপারে সর্তক থেকে সরকারেকে চাপের রেখে নির্বাচনী প্রস্ততি নিচ্ছে দলটি। দলীয় প্রার্থীদের একটি তালিকা তৈরিও কাজও শেষ করেছে বিএনপি। এছাড়া প্রতি নির্বাচনী এলাকার বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর জনমত যাচাইয়ের জন্য ‘গোপন জরিপ’ চালানো হচ্ছে বলেও জানা গেছে। এর জন্য একটি সংগঠনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো সংগঠক জরিপ কাজ পরিচলনা করছে তার জানা যায়নি। দলের হাইকমাণ্ডের নির্দেশেই তা গোপন রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপি এক মধ্যম সারির নেতা।

জানতে চাইলে দলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের জন্য সব সময় প্রস্তত। আগামীতে এক তরফা নির্বাচন বাংলাদেশে হতে দেওয়া হবে না। এর জন্য যা যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে।’

প্রচার-প্রচারণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখনই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলে সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির সুযোগ থাকবে না। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনের নির্বাচনের দাবি আদায়ে দলের নেতাকর্মীদের সক্রিয় রেখে আমরা সামনের দিকে এগুতে চাই। এরইমধ্যে ২০০১ সালের বিএনপি মনোনীত প্রার্থীসহ প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা থেকে ৫ জন করে প্রার্থীর নাম সংগ্রহ করা হয়েছে। জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে তা গুলশান কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। যাচাই বাছাই শেষে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।’

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণায় মেনে বিএনপির অবস্থান জানতে কৌশল অবলম্বন করেছেন। আগামী নির্বাচন বিএনপির ভাবনা সম্পর্কে মাঠের অবস্থান বোঝার জন্যই এমনটা করা হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মিজানুর রহমান শেলী।

তিনি বলেন, ‘বিএনপি যাতে আগামী নির্বাচনে আসে সেই প্রয়াস ক্ষমতাসীন দলের সব সময় থাকবে। কারণে আওয়ামী লগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে তারা ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি সকলকে নিয়ে নির্বাচন করতে পারেননি। সংসদে না হলে মাঠে বড় বিরোধীদল বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তাই এবার বিএনপিকে যেভাবে হউক নির্বাচনে আনতে হবে। বিএনপিও সমস্যা আছে। এবার নির্বাচন না আসলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে।’

শেলী বলেন, ‘বিএপির দলীয়ভাবে গোপনে গোপনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা কাদের মনোনয়ন দেবেন সেটাও ঠিক করছেন। যারা বিএনপির সংসদ সদস্য ছিলেন তাদেরকে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে বলা হচ্ছে মনোনয়নের ব্যাপারে। আর নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। সব কিছু মিলে বিএনপি তাদের দাবি কতটা আদায় করতে পারে সেটা সময়ই বলে দেবে।’

নির্বাচনী প্রস্ততি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল জানান, নির্বাচনী প্রস্ততি আগে থেকেই থেকে শুরু হয়েছে। এখনও এটা চলমান। আমাদের যে সকল প্রার্থীরা মৃত্যুবরণ করেছেন আবার অন্য কোনো কারণে নির্বাচন করার অযোগ্য। যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক প্রার্থীর নাম আমরা পেয়েছি তা যাচাই-বাছাই করে চুড়ান্ত করা হবে।’
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, আগেভাগে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় নামা এটা কোনো কৌশল নয়, এটা দলীয় নীতির একটা অংশ। দলীয় কার্মকান্ডেরর অংশ হিসেবে নির্বাচনকে সমনে রেখে জনগণের কাছে যাচ্ছেন তারা।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘এখানে কৌশলের কিছু নেই। আমরা আমাদের দলীয় নীতি অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় নেমেছি। জনমত গঠনের জন্যই আমরা নির্বাচনীয় প্রচারণায় নেমেছি।’

তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংবিধানের আলোকেই অনুষ্ঠিত হবে। যারা ২০১৪ সালে ন্যায় পেট্রোল বোমা মেরে নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র করতে তাদের জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণ রুখে দিবে।’

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরপর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ক্ষমতার ধারাবাহিকতার ওপর জোর দিচ্ছে। ২০১৯ সালে বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। এর আগে ২০১৮ সালের শেষদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের হাইকমাণ্ড প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশনা মেনেই আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জোরেশোরেই চলছে নির্বাচনী প্রস্তুতি।

নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ‘আগে টার্মটা বুঝতে হবে। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হচ্ছে না। বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতোই সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে।’

২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর থেকেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। এ দাবি পূরণ না হওয়ায় ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন বর্জন করে দলটি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছু নমনীয় হয়ে সহায়ক সরকারের কথা বলছে বিএনপি। তবে রমজান মাসে দল ও জোটের ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘আগামীতে কোনো একতরফা নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না’ বলে ঘোষণা দেন।

সর্বশেষ গত বৃস্পতিবার ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি আয়োজিত ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিএনপি ও ২০ দল ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে বিএনপি জিতবে। আমরা সহায়ক সরকারের কথা বলেছি, সহায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। হতে দেওয়া হবে না।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘নির্বাচনী বাতাস শুরু হয়ে গেছে। আমারা শেখ হাসিনার অধীনের কোনো নির্বাচনে যেতে চাই না। আগামী নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ সরকারে অধীনে। এ জন্য আমাদের দাবি আদায়ে এখন থেকে আন্দোলনের প্রস্ততি নিতে হবে।’

সহায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘এসব ফালতু কথা। বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসবে এবং নির্বাচন সংবিধানের আলোকেই যথা সময়ে অনুষ্ঠিত হবে।’
গত বছর অক্টোবর মাসে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দু’দিনব্যাপী দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মূলত দলীয় সম্মেলনের পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন। চলতি বছরের শুরুতেই বেশে কয়েকটি জনসভায় যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন-প্রত্যাশী নেতারা যার যার নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। অনেকে সপ্তাহের বেশিরভাগ সময়ই নিজ নিজ এলাকায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এমনকি দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে পেতে তারা গ্রাম ও ওয়ার্ডেও দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছেন।প্রতিবেদন পরিবর্তন ডটকমের সৌজন্যে প্রকাশিত।