খালেদার মামলার রায়ের পর কঠোর হবে সরকার

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতি মামলার বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে। মামলার রায়ের পর নির্বাচনী প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেবে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে বিএনপির ব্যাপারেও আবার কঠোর হবে সরকার।

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, তারা মনে করছে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে দলীয় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাজা এড়াতে পারবেন না। তাই রায়ের আগ পর্যন্ত বিএনপির প্রতি কিছুটা নমনীয়তা দেখাবে সরকার। তবে রায়ের পর বিএনপি মাঠে কোনো কর্মসূচি দিলে শক্তভাবে মোকাবিলা করবে তারা।

আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে আগামী নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে চায়। তার আগেই ভোটের মাঠের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শীর্ষ দুই নেতার দুর্নীতির মামলার বিচারকাজ শেষ হবে বলে মনে করছে দলটি। এরপর আগামী নির্বাচনের দিকে পুরো মনোযোগ দেবে, চূড়ান্ত কৌশল ঠিক করবে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটির নেতৃত্ব মনে করে, সাজা হলেও খালেদা জিয়া হাইকোর্টে আপিলসহ পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। কিন্তু তারেক রহমান মামলায় পলাতক আসামি হওয়ায়, তাঁর সেই সুযোগ নেই। তাই মামলার রায় বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য যা করণীয়, সবই করবে আওয়ামী লীগ। এ জন্য সরকার এখন বিএনপিকে রাজনীতির মাঠে কিছুটা সুযোগ দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছে যে আইন চলছে আইনের গতিতে আর রাজনীতি চলছে রাজনীতির গতিতে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, খালেদার মামলা এক বিষয়, আর রাজনীতি অন্য বিষয়। একটার সঙ্গে অন্যটার মেলানোর কোনো সুযোগ নেই। আইন আইনের গতিতে চলছে এবং সেখানে কারও হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। আর রাজনীতি চলবে এর নিজস্ব গতিতে। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে, এটা ইতিবাচক। গণতন্ত্রে এর বিকল্প নেই।
সরকারি দলের একাধিক সূত্র জানায়, ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সৃষ্ট সংকট, সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পদত্যাগসহ নানা কারণে সরকারের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক বোঝানোর জন্যও বিএনপির ওপর চাপটা কিছুটা আলগা করা হয়। যার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের জন্য সড়কপথে খালেদা জিয়া ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়া ও আসার সময় পথে পথে দলীয় জমায়েত করার সুযোগ পেয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও সমাবেশ করতে পেরেছেন। তবে খালেদা জিয়া এরপর ঢাকার বাইরে এ ধরনের সড়কযাত্রা, লংমার্চ, রোডমার্চ বা পথসভার কর্মসূচি দিলে, তা পালন করার সুযোগ না-ও পেতে পারেন।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাজা হলে হয়তো খালেদা জিয়াকে সাময়িক সময়ের জন্য কারাগারে যেতে হতে পারে। এর প্রতিবাদে বিএনপি আন্দোলনে নামতে পারে। সহিংস আন্দোলনে নামলে তখন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার যৌক্তিক ভিত্তি পাবে সরকার। আর দুর্নীতির অপবাদ মাথায় নিয়ে অহিংস আন্দোলনেও সুবিধা করতে পারবে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকার বিএনপির প্রতি গণতান্ত্রিক আচরণ করছে, এটা বলার সময় এখনো আসেনি। ভবিষ্যতে কী করবে, সেটা তাদের বিষয়। তবে অতীতের আচরণ করলে, সে রকমই ফল ভোগ করবে তারা।

এদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের ঢল ও শেখ হাসিনার এ-বিষয়ক কৌশল পশ্চিমা দেশগুলোর প্রশংসা পেয়েছে। নির্বাচনের আগে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য সরকার রাজনীতি স্থিতিশীল রাখতে চায়।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আরও এক বছর বাকি। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা একাধিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান দিয়ে জরিপ চালাচ্ছেন। কিছু জরিপের ফল আশাব্যঞ্জক নয়। অনেক মন্ত্রী-সাংসদের অবস্থান দুর্বল বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতে বিএনপিকে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সে কৌশল ঠিক করার জন্য এখন দলটির মাঠের শক্তি বোঝারও চেষ্টা হচ্ছে।

গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডনে যান। এরপর তিনি দেশে ফিরবেন কি না, সে প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগের নেতারা বক্তৃতা করেছেন। কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে খালেদা জিয়া নানা অজুহাতে আদালত থেকে ১৪০ দিন সময় নিয়েছেন। তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। প্রায় তিন মাস পর গত ১৮ অক্টোবর দেশে ফিরেই পরদিন আদালতে হাজির হন খালেদা জিয়া।

সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যে কিছুটা রাখঢাক দেখা গেছে। সম্প্রতি সৈয়দপুর বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন, সৌজন্যতা অব্যাহত রাখার কথা বলেন। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা শুরু হয় যে বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনীতির অঙ্গনে সাম্প্রতিক পরিবর্তনটা ইতিবাচক। তবে এটা স্থায়ী করতে হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দুই দলের মধ্যে যে অবিশ্বাস-আস্থাহীনতা রয়েছে, তা দূর করতে হবে। নির্বাচনের বিষয়ে সব দল ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলে অন্য বিষয়ে সমস্যা হবে না।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে করা পাঁচটি মামলা আছে। সব কটির বাদী দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাঁচটি মামলাই বিচারাধীন। সব মামলাই এক-এগারোর সময় করা। এর বাইরে বর্তমান সরকারের আমলে নাশকতাসহ আরও বেশ কিছু মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারকাজ এগিয়ে আছে। এর একটিতে তারেক রহমানও আসামি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাতেও তারেক রহমান আসামি এবং এর বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া মুদ্রা পাচার মামলায় বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে ২০১৬ সালে হাইকোর্ট তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকার অর্থদণ্ড দেন। তিনি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেননি। আইনের চোখে তিনি পলাতক।

আওয়ামী লীগের একজন নীতিনির্ধারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটি দুর্নীতির মামলায় তারেক রহমানের সাজা হওয়ায় তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, এটা প্রায় নিশ্চিত। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হলে এবং তা প্রচার করা গেলে রাজনৈতিকভাবে জিয়া পরিবার কোণঠাসা হয়ে পড়বে। তবে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত আইনিপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই খালেদার নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে কারও বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে সাজা হলেই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন, এমন একটা আইন করার চিন্তাভাবনা সরকারের আছে। উল্লেখ্য, বর্তমান নির্বাচনী আইন অনুসারে কারও ন্যূনতম দুই বছরের সাজা হলে, সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী পাঁচ বছর তিনি নির্বাচনের অযোগ্য বিবেচিত হবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির জন্য নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলে এর বিচার স্থগিত রাখা হয়। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির মামলা তা এক-এগারোর সরকারের সময়ে করা। ওই সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছিল। সেগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন সাম্প্রতিক সময়ে যেসব কথাবার্তা বলছেন, তাতে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার একটা প্রবণতা দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রীও যদি উদারতা দেখান, তা গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য ভালো হবে। সূত্র : প্রথম আলো