‘খালেদার মামলার রূপকার জেনারেল মইন উ আহমেদ’

সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মিথ্যা মামলার রূপকার বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি নেতা জমির উদ্দিন সরকার। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক শুনানির সময় আজ বুধবার আদালতে তিনি এ কথা বলেন।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা চলছে পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতে। এ মামলার ঢাকার বিশেষ জজ-৫-এর বিচারক আখতারুজ্জামানের আদালতে বিচারাধীন।

অষ্টম দিনের শুরুতে আজ খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী। জালিয়াতির মাধ্যমে নথি তৈরির অভিযোগ এনে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ছয়জন সাক্ষীর শাস্তি চেয়ে লিখিত আবেদন করে তিনি তাঁর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ করেন। এরপর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বারেক ভূঁইয়ার জবানবন্দি আদালতে পড়ে শোনানোর পর জমির উদ্দিন বলেন, সাক্ষী বারেক বলেছেন, তাঁকে ডেকে এনে তথ্য লেখান সৈয়দ জগলুল পাশা। যিনি সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর ব্যক্তিগত সচিব।

খালেদার রাজনৈতিক জীবন ধ্বংসের জন্য মিথ্যা মামলা করা হয়েছে দাবি করেন জমির উদ্দিন। যুক্তিতর্কের শুনানির সময় বারবার তিনি সাবেক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের প্রসঙ্গ তোলেন। আদালতকে তিনি বলেন, মাইনাস টু থিওরির অংশ হিসেবে খালেদার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে দুদক। অনেক কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে মইন উ আহমেদকে বিএনপির সরকারই সেনাপ্রধান করেছিলেন বলেও আদালতকে জানান প্রবীণ এই আইনজীবী।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশীদসহ ৩২ জন সাক্ষীর জবানবন্দির গুরুত্বপূর্ণ অংশ পড়ে শোনান জমির উদ্দিন। খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন বলেন, কোনো সাক্ষীই বলেননি খালেদা জিয়া কোনো ব্যাংক হিসাব খুলেছেন। টাকা হস্তান্তরের কোনো কাগজপত্রে খালেদার স্বাক্ষর নেই। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের সঙ্গে কোনোভাবে খালেদা জিয়া জড়িত নন।

কাল বৃহস্পতিবারও খালেদার পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরবেন জমির উদ্দিন সরকার। এর আগে দুদকের পক্ষে মোশাররফ হোসেন কাজল খালেদা জিয়াসহ অপর আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করে যুক্তিতর্ক শেষ করেন।

আদালতের ভর্ৎসনা
দেরিতে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের ভর্ৎসনা করেছেন আদালত। এ সময় আদালত আট দিন ধরে চলতে থাকা যুক্তিতর্ক শেষ করতে বললে হইচই শুরু করেন খালেদার আইনজীবীরা।

বেলা ১১টা ৫২ মিনিটে আদালতে হাজির হন খালেদা জিয়া। দুপুর ১২টায় বিচারক এজলাসে বসেন। খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক শুরু করেন তাঁর আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। সে সময় আদালত বলেন, ‘আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা সকাল সাড়ে নয়টায়। আপনারা ১২টার সময় কেন এলেন? আপনারা আসেন না আসেন, এরপর থেকে আমি সকাল সাড়ে ১০টায় আদালতের কার্যক্রম শুরু করব।’

আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলীর উদ্দেশে বিচারক বলেন, তিনি অষ্টম দিনের মতো যুক্তিতর্ক শুনছেন। এর আগে খালেদা জিয়ার অপর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বিস্তারিত বলেছেন। ‘আজই আপনারা শেষ করবেন’—আদালত এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে এজলাসে উপস্থিত বিএনপির আইনজীবীরা হইচই শুরু করেন। ওই সময় বিচারক বলেন, ‘আপনারা হইচই করলে আমি আদালতের কার্যক্রম মুলতবি করব।’

তখন খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী আবদুর রেজাক খান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, মামলার প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে যুক্তিতর্ক তুলে ধরতে। যতক্ষণ প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আমাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ না হচ্ছে, ততক্ষণ অনুগ্রহ করে আমাদের সময় দেবেন।’ এরপরই পরিস্থিতি শান্ত হয়।

রেজাক খানকে সমর্থন করে মোহাম্মদ আলী আদালতের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি আমাদের কেন সময় বেঁধে দিচ্ছেন? আমি তো জাল নথিপত্র তৈরি করে মামলাটি করা হয়েছে বলে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছি। জাল নথিপত্র তৈরি করা অপরাধ।’

এরপর মামলায় অষ্টম দিনের মতো যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হয়। এর আগেও ৪ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক শুনানি করেন এ জে মোহাম্মদ আলী। তাঁর কাছে আদালত জানতে চান, কুয়েতের আমির কত টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে দান করেছিলেন?

এ সময় এ জে মোহাম্মদ আলী আদালতকে বলেন, এই তহবিল পাবলিক তহবিল কি না, সেটা আগে নির্ণয় করতে হবে। এই টাকার উৎস নির্ণয় করা জরুরি। এর আগে তিনি সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুস সাত্তারের জবানবন্দি ও জেরার অংশ পড়ে শোনান। আদালতকে তিনি জানান, বাংলাদেশে কুয়েত দূতাবাস থেকে যে পত্র দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বলা আছে, কুয়েতের আমির জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকেই টাকা দেন। এরপরই আদালত তাঁর কাছে কত টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে দেওয়া হয়েছিল তা জানতে চান। জবাবে তিনি বলেন, এই পত্রে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। তখন আদালত তাঁর কাছে আবার প্রশ্ন করেন, টাকার অঙ্ক যেহেতু উল্লেখ নেই, তাহলে আপনারা কী জানতে চেয়েছিলেন। ওই পত্র কার স্বাক্ষরিত, এটাও আদালত তাঁর কাছে জানতে চান।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া, তাঁর বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ছয়জন আসামি।

তদন্ত কর্মকর্তাসহ ছয় সাক্ষীর বিরুদ্ধে শাস্তির আবেদন
জাল নথি তৈরি ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগ এনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ছয়জন সাক্ষীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করেছেন খালেদা জিয়া। তাঁর পক্ষে আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী লিখিত আবেদন জমা দেন আদালতে। ওই ছয়জন হলেন তদন্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ এবং সাক্ষী মাজেদ আলী, সৈয়দ জগলুল পাশা, তৌহিদুর রহমান খান, মোস্তফা কামাল মজুমদার ও আবদুর বারেক ভুঁইয়া। খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ারও আবেদন করেন এ জে মোহাম্মদ আলী। এর আগে খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তিতর্ক শুনানি করেছেন খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আবদুর রেজাক খান।

২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুদক এ মামলা করে। ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট এ মামলায় খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, মাগুরার বিএনপির সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভাগনে মমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মামলায় শুরু থেকে পলাতক আছেন কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান।