খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপিতে উৎকণ্ঠা বাড়ছে

দলীয় প্রধান কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিএনপিতে। দলীয় সভা-সমাবেশ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এমনকি ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের উৎকণ্ঠার কথা প্রকাশ করছেন নেতাকর্মীরা।

কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে জীবিত ফেরত মিলবে কি না- এমন প্রশ্নও রেখেছেন অনেকে। দিন যত যাচ্ছে এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। দলীয় প্রধানের মুক্তির জন্য হাইকমান্ডের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে কর্মসূচি গ্রহণ ও পালন করছেন। দুদিন আগে অনশন কর্মসূচি পালন করেছে কেরানীগঞ্জ স্থানীয় বিএনপি।

বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে উঠে এসেছে উষ্ণ চিত্র। তাদের ভাষায়, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। তিলে তিলে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দলের নীতিনির্ধারকরা সভা-মঞ্চে আহাজারি ছাড়া দৃশ্যত কিছু করছেন না। শিগগিরই খালেদার মুক্তির বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে নেতাদেরই তোপের মুখে পড়তে হবে। কেউ কেউ এর দলীয় নেতাদের প্রতি অভিযোগের তীর ছুড়ছেন। ঘরের শত্রু চিহ্নিত করার দাবিও রেখেছেন।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি খালেদা জিয়া। এক কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে রয়েছেন তিনি।

বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বেগম খালেদা জিয়া রিউমেট্রিক আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস ম্যারিটা, হাইপারটেনশন, টানেল সিনড্রোম, ফ্রোজেন স্নোডার, লাম্বার স্টোনাইসিস, থাইটিকা, ক্রনিক হাইপোনিথ্রেমিয়া, ক্রোনিক কিডনিসহ বেশ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে আগে থেকেই কয়েকটি রোগে ভুগছিলেন তিনি। আবার কিছু নতুন। তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। কারাগারেই চিকিৎসক দেখাশোনা করছেন কিন্তু এখনো উন্নতি হয়নি।

মুক্ত খালেদা জিয়া ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেন, বন্দিদশাতেও ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চান তিনি। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে সাড়া মিলছে না। দিন, মাস, বছর গড়ালেও খালেদা জিয়ার দাবি মানা হচ্ছে না। দাবি মানতে বা খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আইনি লড়াই হলেও রাজপথে তাকে নিয়ে ‘হাত ধরাধরি’ (মানববন্ধন) ছাড়া এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো কর্মসূচিতে যায়নি বিএনপি। তৃণমূল বিএনপি চায় জোরালো কর্মসূচি।

দলীয় ফোরাম, সভা-সমাবেশ, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভের কথা, প্রত্যাশার কথা, দাবি-দাওয়া নিয়ে মতামত ব্যক্ত করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে স্থাপিত বিশেষ আদালতে গত মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। তিনি জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন অত্যন্ত অসুস্থ। ১৯ মার্চ আদালতে আসার আগে বমি করেছেন খালেদা জিয়া। তিনি মাথা সোজা রাখতে পারছেন না। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে ক্রমেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ বিএনপি মহাসচিবের।

খালেদা জিয়াকে সামনাসামনি দেখা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমি সম্প্রতি বেগম জিয়াকে দেখে এসেছি। তার শরীর এতটাই খারাপ যে, আগে কখনোই এমনটা দেখিনি। কিন্তু সরকার তাকে কোনো চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে না। তিনি তো সাধারণ নাগরিক নন।’

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে দ্রুত মুক্ত করতে না পারলে কারাগার থেকে আমাদের লাশ গ্রহণ করতে হবে।’

ছাত্রদলকর্মী ইসমাইল হোসেন তার ফেসবুকে লিখেছেন, খালেদা জিয়া ধীরে ধীরে মৃত্যুকূলে ঢলে পড়ছেন কিন্তু আমাদের নেতাদের গরজ দেখা যাচ্ছে না।’ তারই পোস্টে জহুরুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘খালেদা জিয়া বন্দি হবার পর আমাদের নেতারা বলেছেন, মুক্ত খালেদা জিয়ার চেয়ে বন্দি খালেদা অনেক শক্তিশালী, এখন নেতাদের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে জীবিত খালেদা জিয়ার চেয়ে মৃত খালেদা অনেক শক্তিশালী এ বক্তব্য দিতে চায়। নইলে আর কত অসুস্থ হলে নেতারা মাঠে নামবে’- প্রশ্ন রাখেন ওই কর্মী।

ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আমাদের নেতাদের চলন-বচনে তা মনে হচ্ছে না।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান বিএনপির নেতাকর্মী নয়, শুধুই শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বিএনপির নেতাকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই তিনি তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন- ‘অতি আশাবাদ, সুবিধাবাদ, হঠকারিতা, আত্মপ্রচার, ব্যক্তিবন্দনা, আন্তঃকোন্দল, ঘাপটি মেরে থাকা গৃহশত্রু এবং অনৈতিকতার বিরুদ্ধে আরো বেশি সজাগ ও সতর্ক হওয়া অতিশয় জরুরি হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। বিপুল শক্তি ক্ষয় হয়েছে। অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে কোনো সুফলই ঘরে তোলা যায়নি। তাই এখন সবচেয়ে কম ক্ষয়ে সবচেয়ে বেশি অর্জন- এর কৌশল গ্রহণের চেষ্টা করতে হবে।’

খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি শুধু আইনি প্রক্রিয়ায় সম্ভব নয়। বিষয়টি রাজনৈতিক। তাই তার মুক্তির দাবিতে রাজপথের আন্দোলনও করতে হবে। আমরা রাজপথ গরম করতে পারছি না বলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি পাওয়ার পথ সুগম হচ্ছে না।