খাশোগি হত্যাকাণ্ড : সৌদি স্বীকারোক্তি কি যথেষ্ট?

অবশেষে সাংবাদিক খাশোগি নিখোঁজ হওয়ার ১৭ দিন পরে সৌদি আরব তাকে হত্যার কথা স্বীকার করল। কিন্তু এমন কিছু ছেলেমানুষি গল্প বানিয়ে স্বীকার করল যে, সারা বিশ্ব জনমতের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হলো।

দেশটির প্রধান কৌঁসুলি এক বিবৃতিতে বলেন, সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের মধ্যেই হত্যা করা হয়েছে। তবে তার হত্যার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয় নাই বরং কনস্যুলেটে দেখা করতে যাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে খাশোগির লড়াই হয় বলে দাবি করে দেশটির প্রধান কৌঁসুলি।

কিন্তু সৌদি আরব এই ১৭ দিন বসে আমেরিকার ট্রাম্প সরকারের সঙ্গে পরিকল্পনা করে এটা এমনই এক ঠুকনো যুক্তি দাঁড় করল যা বিশ্বের কাছে কোনো গ্রহণযোগ্যতা তো পায়নি বরং সারা বিশ্বের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে মিথ্যা বলার একটা শিল্প আছে। মিথ্যাটা এমন সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করা হয় যেটা সত্যের মতো মনে হয়। কিন্তু সৌদি আরব মিথ্যাটা এমনভাবে উপস্থাপন করল যাতে কোনো প্রমাণ ছাড়াই তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব।

ঘটনার শুরু থেকেই সৌদি আরব বারবার তার নিখোঁজের ব্যাপারে কোনো কিছু জানার কথা অস্বীকার করে আসছে। সৌদি কনস্যুলেটের পক্ষ থেকে এবং ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ব্লুম্বার্গ টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে খাশোগির নিখোঁজের ব্যাপারে তার সরকার কিছু জানে না। এমনকি তার কনস্যুলেট ভবন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার সরকার ১০০ ভাগ নিশ্চিত বলে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন সে ঘোষণা প্রধান কৌঁসুলির বিবৃতির মাধ্যমেই মিথ্যা প্রমাণিত হলো।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে :

১. কেন সৌদি আরব খাশোগি হত্যার ব্যাপারটা প্রথম অস্বীকার করে ১৭ দিন পরে স্বীকার করল?

২. সৌদি আরবের এই স্বীকারোক্তি কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

৩. খাশোগি যে হাতাহাতিতে মারা গেছেন তার প্রমাণ কী?

৪. তার মরদেহ কোথায়?

৫. বিশ্ব বিবেক এই ঘটনার কি জবাব দেবে?

হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে। হয়তোবা কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়াই যাবে না। কিন্তু এটা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, সৌদি আরব তার ডিপ্লোমেটিক মিশনের মধ্যে তারই দেশের একজন সাংবাদিককে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।

এই হত্যার দায়ভার সৌদি সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারবে না। এক্ষেত্রে তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

যদিও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোগলু জোর গলায়ই বলেছেন যে, তারা তদন্তের ফলাফল সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরবেন।

কিন্তু সৌদি যে আমেরিকা এবং তুরস্কের সঙ্গে একটা চুক্তি করেই এই স্বীকারোক্তি দিল সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।

শুক্রবার রাতে সৌদি কৌঁসলির ঘোষণার এক ঘণ্টা আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান এবং সৌদি বাদশা সালমান ফোনালাপ করেছেন। যদিও তাদের ফোনালাপের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। কিন্তু সৌদি বাদশা যে স্বীকারোক্তি দেয়ার আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে আগাম জানান দিয়েছেন, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু আসল দেখার বিষয় হচ্ছে তুরস্ক কি ঘটনাটাকে সৌদির ইচ্ছা অনুযায়ী ধামাচাপা দেবে নাকি সৌদির পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার মোর ঘুরিয়ে দেবে, নাকি সত্য ঘটনা উন্মুক্ত করবে।

পশ্চিমা মিডিয়া তুরস্কের ওপরে চাপ সৃষ্টি করছে সত্য ঘটনা প্রকাশ করার জন্য। ফলাফল দেখার জন্য হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে।

তবে যে বিষয়টি এখানে প্রকাশ্য হলো সেটা হচ্ছে সৌদি সরকারের মদদ ছাড়া এত জঘন্য একটা হত্যাকাণ্ড কনস্যুলেট ভবনের মধ্যে ঘটা সম্ভব না। আর তুরস্ক যে শুরু থেকেই বলে আসছে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটাও সত্য।

তুর্কি মিডিয়ার ফাঁস করা তথ্য সৌদি আরবের সরকারি এবং রাষ্ট্রীয় সমগ্র বিবৃতির চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু সৌদি সরকারের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর শনিবার দুপুরে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল একে পার্টির মুখপাত্র ওমের চেলিক স্পষ্টই ঘোষণা দিলেন যে তুরস্ক খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পেছনের মূল রহস্য উদ্ঘাটন করবেই এবং তদন্তের ফলাফল বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে।

যদি তুরস্ক তার কথায় অটল থাকে তাহলে সৌদির জন্য খুব খারাপ দিন অপেক্ষা করছে।

লেখক : সারওয়ার আলম, ডেপুটি চিফ রিপোর্টার-নিউজ পাবলিশার, আনাদলু এজেন্সি, তুরস্ক