‘খেলাপি ঋণ বিষয়টা কিছুটা ছোঁয়াচে রোগের মতো’

কেলেঙ্কারি, জালিয়াতি, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, খেলাপি ঋণ এরকম বেশ কিছু শব্দ ও নামের সাথে কম বেশি হয়ত অনেকেই পরিচিত। এর কবলে পড়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গত কয়েক বছর ধরে চরম সংকটে রয়েছে।

তাতে তৈরি হয়েছে তারল্যের সংকট। সোজা ভাষায় ব্যাংকে টাকা নেই, পুঁজি নেই, তাই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে ঋণ প্রবাহ কমে যাচ্ছে।

এর পেছনে মুল কারণ তুলে ধরছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসেইন।

তিনি বলছেন, “সময়মত ঋণ ফেরত না দেয়া। এটাই, যাকে বলে কিনা একটার কারণে আরেকটি সমস্যা তৈরি হওয়া। এই বিষয়ে একবার যদি ছাড় দিতে থাকেন, কিছুটা ছোঁয়াচে রোগের মতো যে ও দেয়নি, পার পেয়ে গেছে, আমিও চেষ্টা করি, সেই পথ অনুকরণ করি। এই ভাবে জিনিসটা একটা ডমিনো এফেক্টের মতো ছড়িয়ে যায়।”

তিনি বলছেন বাংলাদেশে অর্থ ঋণ আদালত আইন ও দেউলিয়া আইনের মধ্যে ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ফাঁকফোকর রয়ে গেছে।

ঋণ খেলাপিদের জন্য তা টিকে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে।

তার মতে যাদের এইদিকগুলোর দিকে নজরদারি করার কথা তারা স্বাধীনভাবে সেটি করতে পারছেন না।

ব্যাংক পরিচালনায় পেশাদারিত্বের অভাব, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, কাঠামোগত দুর্বলতা, আর হস্তক্ষেপ সহ এই খাতে সুশাসনের অভাবকে অনেক বেশি দায়ী করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম।

তিনি বলছেন, “ব্যাংকগুলোর মালিকানা দেখলেই বোঝা যায় যে এর সাথে কোন না কোন রাজনীতিপুষ্ট। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা তো সরকারেরই। নৈতিকভাবেই সেটা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ যে নৈতিকভাবে মালিকানা বা নিয়োগ যদি হয়েও থাকে ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব হল কিনা।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার উপরে ছাড়িয়ে গেছে।

যার প্রায় অর্ধেকই সরকারি ব্যাংকগুলোতে। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাত থেকে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ জালিয়াতি হয়েছে।

এসব সংখ্যার হিসেব কতটা ভয়াবহ রকমের গুরুত্বপূর্ণ তা খালি চোখে হঠাৎ করে বোঝা যায়না।

কিন্তু এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে। যেমনটা বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক নাজমা বেগম।

তিনি বলছেন, “ব্যাংকে যখন টাকার পরিমাণ কমে যায় আমরা সেটাকে তারল্য সংকট বলি। যখন তারল্য সংকট হয় তখন ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্যাপাসিটিটা কমে যায়। তখন যারা বিনিয়োগে যেতে চায় তারা ঋণ পায়না। তাই বিনিয়োগে যেতে পারে না। বিনিয়োগ কমে গেলে অর্থনীতির উপর নানা প্রভাব পরে। অর্থনীতির গ্রোথ কমে যেতে পারে। চাকরী তৈরির সুযোগ কমে যাবে।”

এবার বাজেট পেশ করার সময় ব্যাংক খাতে সংস্কারে কথা আবারো উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন ঋণ খেলাপিদের শাস্তি পেতেই হবে।

এই খাতকে স্থিতিশীল করতে অর্থমন্ত্রীও বেশ কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন আবারো সংশোধন করা ও একটি কমিশন গঠন করা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালকদের একজন মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলছেন তারা খেলাপি ঋণের অর্থ আদায়ের চেষ্টায় কিছু সুযোগ দিচ্ছেন।

যার একটি হল বকেয়া ঋণের ২% টাকা জমা দিলে ঋণ পুন:তফসিল করা যাবে।

এরপর এক বছর ঋণ পরিশোধ না করে বাকি টাকা ১০ বছরের মধ্যে দিলেই হবে।

তিনি বলছেন, “এটাকে এক্সিট প্ল্যান বলতে পারেন। যাতে ঐ লোণগুলো আদায় হয় তাই একটু ব্রিদিং টাইম পাবে।”

কিন্তু ব্যাংক খাতে সবচাইতে বড় ব্যাধি ঋণ খেলাপিদের বিচারের আওতায় না এনে, অর্থ আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বদলে এই পদক্ষেপ তাদের উল্টো বিশেষ সুবিধা দেবার সামিল বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

আর এরকম সময় তাদের বারবার দেয়া হচ্ছে।

বড় ধরনের ঋণ শোধ না করলেও দিব্যি পার পাওয়া যায় এই সংস্কৃতিই যেন বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে।