গভীর সংকটে বিএনপি : পথ খুঁজছেন দিশাহারা নেতারা

গভীর সংকটের চোরাবালিতে বিএনপি। এই সংকটে থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে এতদিনকার রাজপথের বিরোধী দলটি। বিএনপির বোদ্ধারা মনে করছেন, দলটিকে জন্মলগ্ন থেকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে, হাঁটতে হয়েছে কণ্টকাকীর্ণ পথের বাঁকে বাঁকে। তবে এবারের মতো সংকটের এতটা দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয়নি কোনো সময়েই। প্রায় এক দশক ধরে কঠিন চ্যালেঞ্জের বেড়াজালে জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটি। দীর্ঘদিন নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে থাকা এ দলটি এবার আরও চাপে পড়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে।

একাদশ নির্বাচনে ‘শোচনীয় পরাজয়ে’র পর দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ভেঙে পড়েছেন। তাদের মনোবল এখন শূন্যের কোটায়। এক দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটিকে একদিকে অন্তত আরও পাঁচ বছর ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে থাকতে হচ্ছে।

অন্যদিকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাদের সামনে হাজার হাজার মামলার খড়গ। মামলার ভারে ন্যুব্জ অনেক নেতাকর্মী। রয়েছে হুমকি-ধমকি-এমনকি দল ছাড়ার চাপ। সব মিলিয়ে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে বিএনপি।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের। ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে মহাজোট পেয়েছে ২৮৮ আসন, যার ২৫৯টি আসনই এককভাবে পেয়েছে আওয়ামী লীগ। আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুটি বৃহৎ জোটের ২৭ দল মিলে পেয়েছে মাত্র ৭টি আসন। দেশজুড়ে এত জনমত থাকা সত্ত্বেও বিএনপি পেয়েছে মাত্র ৫টি আসন। শুধু তাই নয়, দলের বাঘা বাঘা নেতারা জামানত খুঁইয়েছেন। বিরোধী দলও হতে পারছে না বিএনপি। এ নিয়ে বিএনপিতে বিরাজ করছে রাজ্যের হতাশা।

কয়েকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দলটির কেন এ ভরাডুবি তা নিয়ে সর্বত্রই চলছে আলোচনা-গুঞ্জন। দলটির নেতাকর্মীরাও পরাজয়ের কারণ ব্যবচ্ছেদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর।

বিএনপির নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, এ নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতাসীন দলের ভোট কারচুপি ও ভোটকেন্দ্র দখল এবং সারা দেশের নেতাকর্মীদের মামলা-হামলা দিয়ে দৌড়ের ওপর রাখাটাই দায়ী। এসব কারণে ভোট দেয়া তো দূরের কথা, বেশিরভাগ কেন্দ্রে দলটি এজেন্টই দিতে পারেনি। কিন্তু এটিকে পরাজয়ের একমাত্র কারণ মানতে নারাজ ।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন-নেতৃত্বে দূরদর্শিতার অভাব, সংকটময় মুহূর্তে কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতা, লেজেগুবরে সাংগঠনিক হাল, প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল সিদ্ধান্ত, অভ্যন্তরীণ কোন্দল সামাল দিতে না পারা, কেন্দ্রে এজেন্ট দিতে না পারা, জোটসঙ্গীদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতাসহ অন্তত সাতটি কারণে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির বিপর্যয় হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ইতিমধ্যে শোচনীয় পরাজয়ের কারণ খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট আসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের আসনভিত্তিক পরাজয়ের কারণ লিখিত আকারে কেন্দ্রে জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হতে পারে। বিপর্যয় বিশ্লেষণ করে পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল খুঁজছেন দলটির দিশাহারা নেতারা।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন করতে গিয়ে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে দলটি। যদিও প্রাথমিকভাবে ভোটের তিন দিন পর আগামীকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনকে প্রার্থীদের মাধ্যমে স্মারকলিপি দেয়ার দুর্বল কর্মসূচি নিয়েছে দলটি।পরবর্তী সময়ে নতুন কর্মসূচি দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা। তবে আপাতত হরতাল-অবরোধের মতো বড় কর্মসূচি দেবেন না বলে জানা গেছে।

বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ভেবেছিল-‘ভোট ডাকাতির’ নির্বাচন আন্তর্জাতিক বিশ্ব প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ প্রায় সব পরাশক্তি নির্বাচনকে মেনে নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন ‘কারচুপি’র অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি আদায়ে বিএনপি কতটুকু সফল হবে তা নিয়েও চলছে জল্পনা-কল্পনা ও হিসাব-নিকাশ।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ধানের শীষের সাত বিজয়ী শপথ নেবেন না। ‘সাজানো’ নির্বাচন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তারা। ভোট কারচুপির তথ্য-উপাত্ত বিদেশি গণমাধ্যম, কূটনীতিকদের অবহিত করা হবে।

এ জন্য সব প্রার্থীকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় ডাকা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ভোট কারচুরি ও কেন্দ্র দখলের তথ্য চাওয়া হবে। সেগুলো সন্নিবেশ করে কূটনীতিকদের কাছে দেয়া হবে। বিএনপির বুঝাতে চাইবে, এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। তাই অনতিবিলম্বে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি সুষ্ঠু ভোটের দাবি জানাবে দলটি। এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে মঙ্গলবার (১ জানুয়ারি) বিএনপির আন্তর্জাতিক উইংয়ের নেতারা বৈঠকও করেছেন।

এসব বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দিয়ে আমাদের নির্বাচনে নিয়ে ভোটের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন করা হয়েছে। ভোটের আগের দিন রাতেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।

বিএনপিরপরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে তিনি বলেন, জোটের প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দেবেন। এর পর নতুন কর্মসূচি দেয়া হবে। কোনোভাবেই ‘ভোট ডাকাতি’র নির্বাচন মেনে নেয়া হবে না বলে জানান তিনি।

বিএনপি এ মুহূর্তে ধীরে চলো নীতিতে এগোবে বলে দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনী সঙ্গী দুই জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ থাকবে কিনা সেটি নিয়ে ভাবছেন দলের সিনিয়র নেতারা।

কারণ এ নিয়ে দলের বহু পোড় খাওয়া নেতার মনে অস্বস্তি কাজ করছে। অনেক নেতা মনে করছেন, তাদের সঙ্গে চললে বিএনপির আলাদা সত্ত্বা বলতে কিছুই থাকবে না। অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এমনটি যারা মনে করেন, তারা দলের বৈঠকে সাড়া দেয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেকে তাদের সঙ্গী করে রাজনীতি করবেন কিনা সেটি পুনর্বিবেচনা করছেন।

এবারের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে নেতৃত্বশূন্য হিসেবে দেখছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন। দলের দ্বিতীয় প্রভাবশালী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন।

এই দুজন গত এক দশক ধরে বিএনপির প্রাণভ্রমরা। যে কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এই দুজনের ওপরই নির্ভর করে থাকেন।

দলের প্রভাবশালী দুজনের নেতৃত্বশূন্যতায় অনেকটা তালগোল পাকিয়ে ফেলে দলটি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য নেতৃত্বের অভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে দলের করণীয় নিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত পায়নি তৃণমূল।

এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচার ও কলাকৌশল নির্ধারণে কয়েক ধরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন খালেদা জিয়া। নির্বাচনী এলাকায় তার গমনাগমন ভিন্নমাত্রা যোগ করে নেতাকর্মীদের মধ্যে। এবারের নির্বাচনে সেটি টের পেয়েছে বিএনপি।

দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা যার যার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ফলে সঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশনা পাননি দলের প্রার্থীরা। হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত হয়ে কেন্দ্রের নির্দেশনা না পেয়ে অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়েন তৃণমূলের নেতারা। কেন্দ্রের নির্দেশনা না পেয়ে নির্বাচনের কয়েক দিন আগে অনেক প্রার্থী হাল ছেড়ে দেন।

ভোটের মাঠে নেতাদের না পেয়ে কর্মী-সমর্থক ও ভোটাররা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন। প্রার্থী ও সিনিয়র নেতারা বারবার নেতাকর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের মাঠে নামার নির্দেশ দিলেও তারাই মাঠে নামেননি। সবার প্রত্যাশা ছিল-অন্তত ভোটের দিন নেতারা মাঠে নামবেন।

কিন্তু নির্বাচনের দিনেও তাদের সেভাবে মাঠে দেখা যায়নি। প্রার্থী ও সিনিয়র নেতাদের মাঠে না পেয়ে সাধারণ ভোটাররা ক্ষুব্ধ হন। তাই অনেকে ভোটকেন্দ্রে যাননি। যার প্রভাব পড়ে ফলে।

নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর ১৮ দিনে বহু স্থানে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন মারাও গেছেন। উল্টো মামলা হয়েছে বিএনপি নেতাদের নামে। এগুলোর কোনো শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেননি কেন্দ্র। এতে হতাশ হয়েছে তৃণমূল। তারা ঝুঁকি নিতে চায় নি, তাই মাঠেও নামেনি।

বিএনপি নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই ভুল পথে হেঁটেছে বলে মনে করছেন দলের একটি অংশ। তারা মনে করে, নির্বাচন নিয়ে সরকারের পাতা ফাঁদে না চাইলেও পা দিয়েছে বিএনপি। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের সঙ্গে দুই দফা আলোচনার সময় কৌশলী হতে পারেনি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

দরকষাকষিতে কোনো ফল আসেনি। তৃনমূল নেতাদের চাওয়া ছিল খালেদা জিয়াকে মুক্তি করে নির্বাচনে যাওয়া। সেটি সম্ভব না হলে অন্তত নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনঢ় থাকা দরকার ছিল বলে মনে করেন বিএনপির একটি অংশ। কয়েক দফা দাবির কোনোটি পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া ভুল ছিল বলে মনে করছেন তারা।

এ জন্য অনেকে নির্বাচনেও অংশ নেননি। যেমন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সরাসরি বলে দিয়েছেন খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে তিনি নির্বাচন করবেন না। তার মতো আরও কয়েকজন এ অবস্থানে অনঢ় ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তারা নানা দিক বিবেচনায় ভোট করেছেন।

সিদ্ধান্ত প্রণয়নে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা সর্বনাশ ডেকে এনেছে বলে মনে করছে বিএনপির একটি অংশ। তাদের অভিযোগ, বিএনপি জনমতহীন কয়েকজন নেতার পেটে ঢুকে পড়েছে, যা থেকে বের হতে পারেনি।

এ জন্য বারবার ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে বিএনপি। যার খেসারত দিতে হয়েছে ভোটে। তাই বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করছেন-ঐক্যফ্রন্ট যেহেতু ভোটের মাঠে ‘খেল’ দেখাতে পারেননি। তাই তাদের ভার বহন করার কি দরকার? তাদের নিয়ে ব্যস্ত না থেকে সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর দিকে মন দেয়া উচিত।

নির্বাচনের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে জোটে রাখাকেও দায়ী করছেন অনেকে। বিজয়ের মাসে তাদের হাতে ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেয়াকে নতুন ভোটারদের বড় একটি অংশ ভালোভাবে নেয়নি। সুশীল সমাজসহ সচেতন নাগরিকও বিএনপির এই কৌশলকে গ্রহণ করেননি, যা ভোটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই বিএনপির অনেক নেতা মনে করছেন, যেই ভোট ব্যাংকের দোহাই দিয়ে এতদিন জামায়াতের সঙ্গ ছাড়েনি বিএনপি, এবার সময় হয়েছে তাদের ছেড়ে আসার।

একাদশ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিএনপির পরাজয়ের কারণ বলা খুব দুরূহ। দলটির পক্ষ থেকে ভোট কারচুপির যে অভিযোগ করা হচ্ছে, এর বাইরেও তো আমরা তাদের মাঠে সেভাবে সক্রিয় দেখিনি।

নির্বাচনের দিন তারা মাঠে থাকতে পারেনি। এর মধ্য দিয়ে দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া বিজয়ের মাসে জামায়াতকে ধানের শীষের প্রতীক দেয়ায় ভোটারদের একটি অংশ তাদের ভালোভাবে নেয়নি।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও দায়ী ছিল। নেতাকর্মীরা বলছেন, ভোটের মাঠে অনভিজ্ঞ-অপরিচিত, রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয় অনেককে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। যাতে ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

যোগ্য ও ত্যাগীদের বাদ দিয়ে সুবিধাবাদী, কথিত সংস্কারপন্থী ও অন্য দল থেকে এনে অনেককে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েও কোনো ফল পাননি ত্যাগীরা।

হাইকমান্ডের চাপে তারা নীরব হলেও ভোটের মাঠে আর সক্রিয় হননি। বিশেষ করে কথিত সংস্কারপন্থীদের যেসব আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় এবং অযোগ্যদের যেখানে মনোনয়ন দেয়া হয়, সেখানে নেতাকর্মীরা তার পক্ষে মাঠে নামেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বরিশাল-১ আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল কথিত সংস্কারপন্থী জহির উদ্দিন স্বপনকে। তার পক্ষে ছিলেন না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তিনি এলাকায় খুব একটা যেতে পারেননি। ফলও যা হওয়ায় তাই হয়েছে।

চাঁদপুরের সাবেক জনপ্রিয় এমপি এহসানুল হক মিলনকে মনোনয়ন না দিয়ে দেয়া হয়েছিল আনকোরা একজনকে, যা কেউ-ই ভালোভাবে নেননি। আবার নারায়ণগঞ্জে তৈমূর আলম খন্দকারকে মনোনয়ন না দিয়ে যাকে দেয়া হয়েছে তার পক্ষে মাঠে নামেননি সেখানকার নেতাকর্মীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে দলীয় কিছু ভুল থাকতে পারে। কিন্তু এ নির্বাচনে এটিই প্রমাণিত হয়েছে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনও অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়।

সূত্র জানায়, নির্বাচনের ফলে হতাশ বিএনপি নেতারা পরবর্তী করণীয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে এবং জোটের সঙ্গে দফায় দফায় আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। সোমবার দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে মিলিত হন।

মঙ্গলবারও (১ জানুয়ারি) অনানুষ্ঠানিকভাবে দল ও জোটের শীর্ষ নেতারা করণীয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। এসব বৈঠকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত হয়নি বলে মত দেন অনেকে।

তবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ শীর্ষ নেতারা বলেন, দেশের সুশীল সমাজ ও বিদেশিরা নির্বাচনে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এ জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ না থাকা সত্ত্বেও তারা অংশ নেন। বিদেশিদের কথায় অংশ নিয়ে দল এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কোনো কোনো নেতা।

এমতাবস্থায় বিএনপি নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে কোনো হটকারী কর্মসূচি দেয়া ঠিক হবে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী ভেবেচিন্তে পথ চলতে হবে। বিএনপির করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন’ গঠনের দাবি তোলা যেতে পারে। নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখবে ওই কমিশন; যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।

বিএনপিকে ভুলত্রুটি শোধরানোর পরামর্শ দিয়ে এমাজউদ্দীন বলেন, সংকট থেকে উত্তরণে বিএনপির উচিত হবে-তাদের কোনো ভুলত্রুটি থাকলে তা খুঁজে বের করে সংশোধন করা। সংগঠনকে ঠেলে সাজানো এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির পথ খুঁজে বের করা।

বিএনপির কয়েক নেতা জানান, বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আপাতত রাজপথে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেবে না বিএনপি। কারণ কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের বহু নেতার নামে শয়ে শয়ে মামলা দেয়া আছে। বিএনপি কঠোর কর্মসূচি দিতে গেলেই ওই সব মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। তখন নেতৃত্বশূন্যতায় পড়বে দলটি।

এমতাবস্থায় নির্বাচন নিয়ে খুব একটা না ভেবে সংগঠন ঢেলে সাজানো এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপির রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে, খালেদা জিয়ার শারীরিক যে অবস্থা তাতে করে তিনি যদি অচিরেই মুক্তি না পান, তা হলে তার স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বাড়বে। তখন বিএনপির সংকট আরও গভীর হবে। সে জন্য খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ অনেকের।