গামছায় বাঁধা পিতা-পুত্রের সম্পর্ক!

বাবা। মায়ের পরেই তার স্থান। নিজের শ্রম, বুদ্ধি আর মেধা দিয়ে তিনি উপার্জন করে পরিবারের ভরণপোষণে ব্যস্ত সময় পার করেন। নিয়মিত ঘামঝরা পরিশ্রম দিয়ে তিনি পরিবারের মুখে হাসি ফোটান। রোদে পুড়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে জীবনের বহু পথ তাকে বাস্তবতার সঙ্গে পারি দিতে হয়। শুধুমাত্র পরিবারের সুখ-শান্তির কথাই বাবার চিন্তাজুড়ে বসবাস করে। তাই নিজের কষ্ট আর ইচ্ছাকেও জলাঞ্জলি দিতে তিনি পিছপা হন না। বাবা তার শেষ জ্ঞান থাকা পর্যন্তও সন্তানকে আগলে রাখেন। সন্তানের শরীরের সামান্য আঁচড় যেন তার নিজের শরীরের আঁচড়ের থেকেও বেশি বেদনাদায়ক। সেই বাবা-ই তো মহান!

মায়ের পর তিনিই সন্তানদের এক গভীর আদর্শ। তেমনই এক বাবা রহমত আলী। সন্তান আর পরিবারের ভরণ-পোষণ যোগাতে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করছেন। স্ত্রী অন্যের বাসায় কাজ করে যে টাকা পায়, তা দিয়ে বস্তির ঘর ভাড়া দিতে হয়। তাই মাঝে মাঝে হাতে কাজ (দিনমজুরির) না থাকলে ভিক্ষাকে বিকল্প ভেবে কাজ হিসেবে বেছে নেন তিনি।

কাজের টানে যেখানেই যান না কেন রহমত আলী তার একমাত্র সন্তানকে সব সময় কাছেই রাখেন। ছোট ছেলে এদিক-ওদিক চলে যায়। তাছাড়া বস্তিতে বাচ্চা চুরির ভয়ে কখনো সে সন্তানকে ঘরে একা রেখে আসেন না।

ঢাকার আলো-বাতাস ঘিরে এ শহরের বিভিন্ন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে রহমত আলী বড় হয়েছেন। তার দেখার মত কেউ ছিল না। নানির কাছে বড় হয়েছেন। বাবার খোঁজ পায়নি কখনো। রহমত আলী তাই পিতার স্নেহে সন্তানকে দিতে চাইছেন। সে কারণেই সন্তানকে তিনি এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করেন না।

সন্তানের প্রতি তার সেই টান ছবি দেখেই আঁচ করা যায়। গত শুক্রবার তিনি সন্তানকে নিয়ে শান্তিনগরের রাস্তা ধরে কাকরাইলের দিকে যাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে দু/এক জায়গায় ভিক্ষাও চাচ্ছেন তিনি। কিন্তু এক হাতে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ আর অন্য হাতে সন্তানকে ধরে রেখে ভিক্ষা নিতে তার অসুবিধাই হচ্ছিলো। তাই নিজের গামছা দিয়ে সন্তানের কাঁধের কাপড়ের কিছু অংশ তিনি নিজের সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন।

রহমত আলী জানালেন, ছেলেডা (শিশু শামিম) হারায় যাওয়ার ভয়ে সাথে সাথে রাখতে হয়। বড় হচ্ছে। এদিক-ওদিক চইল্যা যায়। তাই বাইরে কামে (কাজে) বেরইলে প্রায়ই গামছা দিয়া আমার সাথে বাঁইধা রাখি। ছোটবেলায় নানি ছাড়া আমারে কেউ দেহার (দেখাশোনা) মত ছিল না। ছেলের বেলায় হেইডা হইতে দেব না। আস্তে আস্তে বড় কাম ধরবো। ভিক্ষা করাও ছাইরা দেব। ওর মা, আমি ছেলের ক্ষতি চাই না। ল্যাখ্যাপড়া শিখাইতে চাই।

কথাগুলো শেষ হতে না হতেই রহমত আলী সন্তানকে নিয়ে তার নিজ গন্তব্যের দিকে যেতে থাকলেন। একটু দূরে গিয়ে আবারও ভিক্ষা করতে শুরু করলেন। সন্তানের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য পুত্রকে তিনি নিজের গামছা দিয়েই বেঁধে রাখলেন।

আর অবুঝ শিশুটিও যেন বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে চাইলো না। তাইতো সম্পর্ক নামের অদৃশ্য অনুভূতির দৃশ্যমান গামছার টানে বাবার সঙ্গে সমানতালে পা ফেলতে ফেলতে শিশুটি গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো।