গুজব শনাক্তকরণ সেল : কীভাবে, কাদের ঠেকাতে চায়?

ঢাকার বাসিন্দা ইয়াসমিন ইতি ফেসবুকে বেশ সক্রিয়। রাজনীতি এবং বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে ফেসবুকের মাধ্যমে খোলাখুলি মত প্রকাশ করতে পছন্দ করেন তিনি।

কিন্তু বিভিন্ন সময় ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া নানা বিষয় নিয়ে তাঁর মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। কোনটি গুজব আর কোনটি সত্যি, সে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বেশ সময় লাগে তাঁর।

ইয়াসমিন ইতি এমন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন সাম্প্রতিক ‘নিরাপদ সড়ক’ সম্পর্কিত আন্দোলন চলার সময়।

বাংলাদেশে সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় – বিশেষ করে ফেসবুকে – ‘গুজব ছড়ানোর’ বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে।

এমন এক প্রেক্ষাপটে তথ্য মন্ত্রণালয় গুজব শনাক্ত করার জন্য একটি সেল গঠন করেছে। সরকার বলছে, এ সেলের কাজ হবে ফেসবুকে কেউ ‘গুজব’ ছড়াচ্ছে কি-না, তা চিহ্নিত করা এবং যারা কাজটি করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।

তবে ‘গুজব শনাক্তকরণ সেল’ গঠনের খবর নিয়ে ইয়াসমিন ইতি কিছুটা হলেও চিন্তিত।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “অবশ্যই এটা মানসিক চাপ। আমি এরপর থেকে কী লিখব আর কী লিখব না, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।”

তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মালেক জানিয়েছেন, সচিবালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত তথ্য অধিদপ্তরে এখন থেকে ২৪ ঘণ্টা এই সেল কাজ করবে।

গুজব শনাক্তকরণ সেলে ২৪ ঘণ্টায় নয় জন কর্মকর্তা কাজ করবেন। অর্থাৎ প্রতি শিফটে তিন জন করে নজরদারীর কাজ চালিয়ে যাবেন।

তথ্য সচিব মি: মালেক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা গুজব বন্ধ করতে চাই। আমরা যদি কোন গুজব শনাক্ত করতে পারি, তাহলে তখন সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলবো।”

তিনি বলেন, ফেসবুকে গুজব শনাক্ত করার পর সেগুলো সম্পর্কে গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সেল গণমাধ্যমকে সাহায্য করবে, যাতে তারা গুজব নির্ভর কোন সংবাদ পরিবেশন না করে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মন্তব্য, ছবি কিংবা ভিডিও’র উপর ভিত্তি করে গণমাধ্যম নানা ধরণের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

কোন ‘গুজবের উপর ভিত্তি’ করে গণমাধ্যম যাতে খবর প্রকাশ না করে, সে বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সেল দৃষ্টি রাখবে বলে কর্মকর্তারা বলছেন।

তথ্য সচিব বলেন, “ফেসবুক, ইউটিউব বা এ ধরণের সামাজিক মাধ্যম যদি কোন নিউজপেপার বা টেলিভিশন চ্যানেলের নিউজের ভিত্তি হয়, তাহলে সেটার সঠিকতা যাচাই করবে কে?”

“আমরা চিঠি দিচ্ছি সবাইকে যে আপনারা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অসমর্থিত তথ্য নিয়ে ফেক কোন নিউজ বা গুজবকে আপনারা দয়া করে ফেসবুকের রেফারেন্স দিয়ে প্রকাশ বা প্রচার করবেন না।”

তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘গুজব শনাক্তকরণ সেল’ সকল গণমাধ্যমকে সঠিক তথ্য দেবে বলে উল্লেখ করেন মি: মালেক।

বাংলাদেশের সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বলছেন যে তারা সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকের ব্যবহার নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে উঠেছেন। তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এর প্রতিফলনও দেখা যায়।

সরকারের উর্ধ্বতন মহলের অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে ফেসবুক সরকার বিরোধী প্রচারণার একটি বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তারা মনে করেন, অনেক সময় বিভিন্ন ইস্যুতে নানা ‘ভুয়া খবর এবং গুজব’ ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা হয়।

সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় এ ধরণের বিষয় ছড়িয়েছিল বলে সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় বলেছেন। তাঁরা অভিযোগ করেন যে আন্দোলনকারীদের হত্যা এবং ধর্ষণ করার ভুয়া খবর ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছিল।

এরপর থেকেই তথ্য মন্ত্রণালয় গুজব শনাক্তকরণ সেলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বলে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হয়।

তথ্য সচিব মি: মালেক বলেন, “আমরা গুজবকে গুজব হিসেবে জানিয়ে দেয়ার জন্যই কাজ করবো।”

তবে কেবল তথ্য মন্ত্রণালয়ই নয়, ফেসবুকে নজরদারী করার জন্য পুলিশ, র‍্যাব এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে।

রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কর্মীরাও ফেসবুকের উপর কড়া নজর রাখছেন বলে জানা যাচ্ছে।

ক্ষমতাসীনদের ইমেজ রক্ষার জন্য এই উদ্যোগ?
গুজব ঠেকানোর নামে ক্ষমতাসীন দলের ‘অনিয়ম’ চেপে রাখার বিষয়টি আসল উদ্দেশ্য হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় আছে ফেসবুক ব্যবহারকারী ইয়াসমিন ইতির মনে।

তিনি বলেন, “তারা যদি মনে করেন আমরা যতই খারাপ কাজ করি, এরপর সেটা আর ছড়ানোর ভয় নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য অনেকের মনে একটা ভয় তো ছিলই – ‘কেউ হয়তো হুট করে একটা ভিডিও করে ফেললো বা প্রমাণ ছড়িয়ে দিল তখন আমরা বিপদে পড়বো’। অ্যাট লিস্ট, এ ভয়টুকু ছিল।”

“নিজেদের খারাপ কিছু, তারা চেষ্টা করবে যে চাপা পড়ে যাক, শুধু ভালো কিছুই প্রকাশ হোক।”

তবে সরকার যদি ‘সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে’ শুধু গুজব শনাক্ত করার কাজ করে, তাহলে এটি ভালো হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

“অনেকে শুধু গুজব ছড়িয়ে-ছড়িয়ে অনেক লাইকের আশায় এবং অন্য আরো ব্যবসায়ী অসাধু উদ্দেশ্যে যেটা করে থাকে, এটা তো আসলে ক্ষতিকর মানুষের জন্য,” বলছিলেন মিজ ইতি।

ক্ষমতাসীনরা যদি দলীয় স্বার্থে গুজব শনাক্তকরণ সেলকে ব্যবহার না করেন, তাহলে এটি সাধুবাদ জানানোর মতো কাজ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তথ্য সচিব বলছেন, ‘গুজব শনাক্ত’ কারার জন্য যে সেল গঠন করা হয়েছে, তা ‘সঠিক তথ্য’ দেওয়ার কাজ করবে।

ঢাকায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলার সময় ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে পুলিশ ফটোসাংবাদিক শহীদুল আলম এবং মডেল ও অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদকে গ্রেফতার করেছিল।

পরে নওশাবা আহমেদ জামিনে মুক্তি পেলেও তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের মামলায় শহীদুল আলম এখনও কারাগারে আটক রয়েছেন।

-বিবিসি বাংলা