গুপ্ত মানব || আকিদুল ইসলাম সাদী

আকিদুল ইসলাম সাদী : বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি দেশ। তার সৌন্দর্যে পাগল পুরো পৃথিবী। আর গ্রাম বাংলার সৌন্দর্য তো আরও বেশি অতুলনীয়! এক একসময় তার এক একরকম সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। কোনটার সাথে কোনটার মিল নেই। প্রতিটি সৌন্দর্যই রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট। সকালের সৌন্দর্য একরকম, দুপুরের সৌন্দর্য আরেক রকম, বিকেলের সৌন্দর্যও আরেক রকম! কোনটির সাথে কোনটির মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। উপভোগেও ভিন্ন স্বাদ। সকালবেলা পাখিরা শুরু করে কিচিরমিচির ডাক আর প্রকৃতি ছাড়ে হিমেল হাওয়া। দু‘টো মিলে গড়ে ওঠে সুন্দর পরিবেশ! সকালের এই আবহাওয়া যেন কোটি টাকার দাওয়া। দুপুরে থাকে রৌদ্রের প্রখরতা। মাঝে মাঝে প্রবাহিত হয় মৃদু মৃদু বাতাস। বিকেলে শুনা যায় নাড়ির টানে নীড়ে ফিরা পাখিদের গুঞ্জন! গ্রাম বাংলার এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লোক। কবি আসে কবিতা লিখতে, লেখক আসে গল্প-উপন্যাস লিখতে। আহমাদ রায়হান রেজাও তাদের একজন। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে উপভোগ করছে সে গ্রাম বাংলার এই সমস্ত সৌন্দর্য।

ঘুরাঘুরি রুটিন থেকে আজও বাদ পড়েনি। গ্রাম বাংলার মেঠোপথ ধরে সে হেঁটে চলেছে। হঠাৎ করে তার দেখা হয়ে গেলো ছোট্ট একটি মেয়ের সাথে। এই মেয়ে শোন বলেই কথা বলা শুরু করে দিলো আহমাদ রায়হান রেজা।

– নাম কী তোমার?
– কণা!
– শুধুই কণা?
– না, কণিকা আক্তার কণা!
– খুব সুন্দর নাম তো! কী করো তুমি?
– পড়ালেখা করি!
– ও, তাই নাকি? কোন ক্লাসে পড়?
– কেলাস থিরিতে!
– বেশ বেশ! তা তোমাদের বাসা কোথায়?
– ঐযে নদীর ধারে! হাত ইশারা করে দেখালো কণা।
– আচ্ছা, আচ্ছা। তার মানে ঐ বেদেপল্লীতে?
– হ!
– আচ্ছা তোমাদের আশেপাশে কি অনেক বেদে বাস করে?
– হ, অনেক বাইদা বাস করে!
– তা ঐ জায়গায় তোমাদের মতো গৃহস্ত শ্রেণীর লোক কেমন অর্থাৎ কতগুলো আছে?
– আমাগো মতো মানে! আমরা গৃহস্ত না; আমি বাইদার মাইয়া।
– তাই নাকি? আশ্চর্যের ব্যাপার তো! তোমাকে দেখেতো মনেই হয় না যে, তুমি বেদের মেয়ে। তোমার কাপড়-চোপড় তো সাধারণ গৃহস্ত শ্রেণীর লোকদের মতোই। সেলোয়ার-কামিজ তো তোমাদের জাতিরা পরে না বললেই চলে।
– তা ঠিক কইছেন, তবে আমি সেলোয়ার-কামিজই পরি।
– হুঁ, ঠিক বলেছো! সেজন্যই তোমাকে আর দশ-বারোটা বেদের মেয়ের মতো দেখতে লাগে না। আচ্ছা, তুমি এই পোষাক পর বলে কেউ কিছু বলে না? কেননা, তোমাদের জাতির মেয়েরা তো ৫-৭ বছর বয়স থেকেই কাপড় কিংবা ঝালরওয়ালা পেটিকোট পরে। কিন্তু তুমি……..!
– না, আমারে কেউ কিছু কই না। ছোটবেলা থেইকাই আমি এই সব কাপুড় পরি। শুধু তাই-ই না; আমাগো বাড়ির সবাই-ই সাধারণদের মতো পোষাক-আষাক পরে।
– আচ্ছা আচ্ছা, ভালোতো তাহলে! তা তুমি এখন কোথায় যাচ্ছো?
– পেরাইভেট পড়তে যাইতাছি!
– তাই, কার কাছে প্রাইভেট পড়?
– আমাগো আফার কাছে।
– তা তোমার আপারদের বাসা কোথায়?
– ঐ যে ওই বড় বাড়িটাই হইলো আমাগো আফাদের বাড়ি। হাতের ইশারায় দেখালো কণা।
– তোমার আপা কি তোমাদের স্বজাতি?
– না, না, ওনারা অনেক বড়লোক। আমাগো স্বজাতি না। ওনার আব্বা এই এলাকার নামকরা মানুষ।
– তাই নাকি?
– হ!

এভাবে আহমাদ রায়হান রেজা কণাকে আরও অনেক প্রশ্ন করলো। সুন্দরভাবে লক্ষ্মী মেয়ের মতো সে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিলো। কোনপ্রকার প্রশ্ন করলো না। ব্যাপারটা আহমাদ রায়হান রেজার কাছে খুব আশ্চর্যের লাগলো। তাই কণাকে এবার সে অন্য রকমের প্রশ্ন করলো।

– আচ্ছা কণা আমিতো তোমার কাছে অনেক কিছু শুনলাম-জানলাম, কিন্তু তুমিতো আমার কাছে কিছুই শুনলে না!
– আমাগো আফা কইছে, বড়দের কথার উত্তর সম্মানের সহিত দিতে হয়। তাগো থেইকা ছোটগো কিচ্ছু জানতে চাওয়া আদবের খেলাপ।
– আচ্ছা আচ্ছা, সেজন্যই তুমি আমার কথার শুধু উত্তর দিয়ে যাচ্ছো, কিছুই জিজ্ঞাস করছো না?
– হ!
– আচ্ছা, আমিই তাহলে আমার পরিচয় বলছি- আমার নাম আহমাদ রায়হান রেজা, বাসা ঢাকা।
– আপনার বাড়ি ঢাহা!
– হ্যাঁ, কেন কেন?
– না এমনেই! ঢাহার মানুষ দ্যাখার সখ ছিলো, আজ দ্যাইখা ফেললাম!
– আচ্ছা আচ্ছা, তা কী বুঝলে ঢাকার মানুষ দেখে?
– কিচ্ছু না!
– তাই!
– জি!
– আচ্ছা তোমরা কয় ভাই-বোন?
– আমরা দুই ভাই-বোন। আমি আর আমার ভাইয়া।
– ও তাই!

কণার সাথে কথা বলে আহমাদ রায়হান রেজার খুবই ভালো লাগলো। গ্রাম্য আর বইয়ের ভাষা মিশ্রিত করে সে কথা বলে। তার কথার মধ্যে যেন আলাদা একটা স্বাদ রয়েছে। ছোট মুখের কথাগুলো একবার শুনলে যেন বারবার শুনতে মন চাই। আহমাদ রায়হান রেজা তাই কণাকে ছোট্ট বন্ধু হিসেবে ঘুরাঘুরির সাথী করার ইচ্ছে করলো।

– আচ্ছা কণা আমি কি তোমার বন্ধু হতে পারি?
– আপনেতো বড় মানুষ আর আমিতো ছোট। তাহলে বন্ধু হবো কেমনে?
– বন্ধুত্বের মধ্যে বড়-ছোট কোন ব্যবধান নেই। সবাই সবার বন্ধু হতে পারে।
– তাই!
– হুঁ, তাহলে আজ থেকে তুমি আমার ছোট্ট বন্ধু।
ঠিক আছে বলে কণা তার কথায় সম্মতি জানালো।
– আমাকে তুমি তোমাদের এলাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে। ঢাকায় থাকিতো, তাই তোমাদের এলাকা ঘুরে দেখার ভীষণ সখ! কিন্তু সাথী হিসেবে তেমন কাউকে পাচ্ছি না। তোমার সাথে বন্ধুত্ব করে সেই সখটা পূরণ করতে চাই।

– আচ্ছা। তা আপনে থাকেন কোথায়?
– আমি থাকি পলাশপুর বাজারের কাছে একটি বাড়িতে।
– ও!
– আচ্ছা বন্ধু তাহলে এখন থেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য আমি তোমাকে খুঁজে নিবো!
– আচ্ছা, তা আপনে কি আমাগো বাড়ি চেনবেন?
– সমস্যা নেই, চিনে নিবো একভাবে। ঠিক আছে তাহলে, তোমার প্রাইভেটের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাহলে যাও, আবার দেখা হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে বলে কণা হাঁটতে শুরু করলো।

আহমাদ রায়হান রেজা আবারও বিকেলবেলা নদীর ধারে হাঁটতে বের হলো। আর অমনি দেখা হয়ে গেলো কণার সাথে। তার সাথে আলাপও হলো কিছুটা। কথার একপর্যায় কণাকে সে বেদেপল্লী সম্পর্কে বললো। ঘুরে দেখতে চাইলো সেটি। কণার থেকেও আশ্বাস পেলো। কাল থেকে তার সাথে ঘুরবে, বেদেপল্লী সম্পর্কে জানবে। এটা তার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা অনেক দিনের বাসনা। হয়তো এবার পূর্ণ হবে।

আহমাদ রায়হান রেজা এসেছে ঢাকা থেকে। তার বাসা ঢাকা গুলশানে। সেখান থেকে এসে উঠেছে এই অজপাড়া-গাঁয়ে তার এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়র বাড়িতে। সেখানেই আপাতত তার অবস্থান। ঐ বাড়ির লোকজন খুবই ভালো মানুষ। তারা তাকে খুব সম্মান করে। এখানে সে এসেছে কোন একটা কাজের খোঁজে। কাজটা লুকায়ীত। তবে তার আশ্রয়দাতারা জানে অন্যকিছু। তাই তারা তাকে একটা কাজ খুঁজে দিতে উদ্যত হলো। এই অজপাড়া-গাঁয়ে কি কোন কাজ পাওয়া যায়? তবুও সে যখন এসেছে, তাকে তো একটা কাজ দিতেই হবে! আহমাদ রায়হান রেজার ঐ আত্মীয়দের পলাশপুর বাজারে ছোটখাটো একটি হোটেল রয়েছে। আপাতত সেখানেই তাকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিলো। খুবই দক্ষতার সাথে সে হোটেলের সমস্ত কাজ আনজাম দিতে লাগলো। যারফলে অল্প দিনেই সে সকলের আস্থার পাত্র হয়ে উঠলো।

একদিন হোটেলের বাবুর্চি রহমত আলি বললো, রেজা ভাই! আমরা তো দেহি গেরামের লোকজন কাজের তালাশে ঢাহা যায়। আর আপনে এই গৈ-গেরামে আইলেন কেন? আহমাদ রায়হান রেজা উত্তর দিলো, আরে ভাই শহরের ঐ গাড়ির প্যাঁপোঁ, ঘ্যাড়-ঘ্যাড় শব্দ আর ভালো লাগে না। কান যেন একেবারে ঝালাপালা হয়ে গেছে। তাই এই গ্রামের দিকে চলে এলাম, যাতে কিছুদিন একটু শান্তিতে থাকি। রহমত আলি বললো, তাই! সে হুঁ বলে তার কথার সম্মতি জানালো।

আহমাদ রায়হান রেজা থাকার ব্যবস্থা মালিকের বাসায়, মানে ঐ আত্মীয়‘র বাড়িতেই করা হয়েছে। সেখানেই সে থাকে আর অবসর সময়ে পলাশপুরসহ তার আশপাশের গ্রামগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে। আর এ কথাটি সে এখানে আসার পূর্বেই তার ঐ আত্মীয়‘র সাথে কনফর্ম করে নিয়েছে। তবে গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য কোন লোক দিতে পারবে না সে। এটি আহমাদ রায়হান রেজারই ব্যবস্থা করে নিতে হবে। কেননা, অচেনা জায়গা, তারপর আবার ভালোভাবে গ্রামগুলো সম্পর্কে জানতে একজন লোক অবশ্যই লাগবে। তারও ব্যবস্থা সে করে ফেললো। আজ কণার সাথে তার পরিচয় হলো। বন্ধুত্বও হয়ে উঠলো অতি তাড়াতাড়ি। তার মনের বাসনা বেদেরদের সম্পর্কে জানা। কণার সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছে বিধায় এটি অনেকটাই সহজ হবে। ছোট্ট বন্ধু কণা তাকে ঘুরিয়ে দেখাবে সমস্ত বেদেপল্লী। সত্যিই তার খুব মজা লাগছে। অতঃপর অপেক্ষা করতে লাগলো কণার সাথে বেদেপল্লী ঘুরে দেখার। (চলবে…..)