গুম-ক্রসফায়ার পুরোপুরি বন্ধ হবে, ইশতেহারে ঐক্যফ্রন্ট

২০১০ সালের ২৫ জুন, রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম অপহৃত হন। এর দুই বছর পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মধ্যরাতে রাজনীতির বনানীতে থেকে অপহৃত হন বিএনপির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী। পরের বছর ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন সাজেদুল ইসলাম সুমন।

শুধু চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী কিংবা সুমনই নন, তাদের মতো এখন ৪২৩ জন বিএনপি নেতাকর্মী গুম-নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি করেছে দলটি।

২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক পরিসংখ্যানে বিএনপি দাবি করেছে নিহত এক হাজার ৫১২ জন নেতাকর্মীর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৮২ জন।

নিখোঁজ-গুম হওয়া এদের কাউকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তবে, নিখোঁজদের ফিরে আসার অপেক্ষায় আজও আছেন তাদের পরিবার- আত্মীয় স্বজনরা।

স্বজনদের খোঁজ চেয়ে গত ৪ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন ৪০ পরিবার। যাদের বেশিরভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নিখোঁজ কর্মীদের স্বজন।

‘মায়ের ডাক’ নামের একটি সংগঠন এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

সংবাদ সম্মেলনে নিখোঁজ স্বজনরা দাবি করেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী দল রাষ্ট্রীয়ভাবে গুম-খুন ও ক্রসফায়ারের মতো জঘন্য কাজে সম্পৃক্ত হবেন না- তার অঙ্গীকার ইশতেহারে থাকতে হবে।

গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুধু বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলেই যে হয়েছে তা নয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট আমলেও এ ধরনের ঘটনা কম হয়নি।

বিএনপি নেতারা এখন চোখের পানি ফেললেও, তাদের আমলে অনেক মা’র বুক খালি হয়েছে। বিএনপি আমলে নিখোঁজের তালিকাও কম নয়।

একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৪৮৭। এদের মধ্যে ৮১১ জনের মৃত্যু হয় চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ক্রসফায়ারে মারা যায় ৫৪৭ জন।

র্যা ব গঠনের পর থেকে ২০০৪ সালে তথাকথিত ক্রসফায়ারে মারা যায় ৫৫ জন, ২০০৫ সালে ৩৯৫ জন, ২০০৬ সালে ৩৬১ জন, ২০০৭ সালে ৩৫১ জন, ২০০৮ সালে ১৮৬ জন এবং ২০০৯ সালে ১২৯ জন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকে। বর্তমানে এই সরকার টানা দশ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ চলতি বছরে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।

তাতে বলা হয়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৪২২ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে।

শুরু থেকেই গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদ বিভিন্ন কর্নার থেকে হলেও কোনো সরকারই এসব জঘন্য ঘটনা থেকে নিবৃত হয়নি।

বরং অভিযোগ আছে- ক্ষমতায় থাকতে বিরোধী দল, বিরোধী মতকে দমন করে রাখতে গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

সামনে নির্বাচন। তাই গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আলোচনা আবারও সামনে এসেছে।

রাষ্ট্রের সুশীল সমাজ, বিজ্ঞজনেদের পাশাপাশি নিখোঁজ পরিবারের স্বজনরা প্রত্যেক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আর ঘটবে না- এমন অঙ্গীকার চান।

আগামী ৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় এক্যফ্রন্ট। এ ফ্রন্টে রয়েছে বিএনপিও।

যদিও ইশতেহার কমিটির প্রধান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানান ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করা হবে।

এক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে কী থাকছে কিংবা ফ্রন্ট যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে গুম-খুন-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো অঙ্গীকার থাকবে কিনা- এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক শীর্ষ নেতাকে।
কেউ কেউ স্পষ্ট জবাব দিলেও, ধোঁয়াশাও মিলেছে কারো কারো কথায়। কেউ কেউ খসড়া ইশতেহারে এ বিষয়ে কি থাকছে তাও জানিয়েছেন এ প্রতিবেদককে।

এ ব্যাপারে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ উপহার দিতে চাই। ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটি নিন্দনীয় কাজ। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ আছে।’

তবে এ ব্যাপারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, “বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার দেয়া হবে। যার একটা ইঙ্গিত আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ‘ভিশন-২০৩০’তে দিয়েছেন”।

ফখরুল বলেন, ‘আমাদের একটি কমিটি এটা নিয়ে কাজ করছেন। শেষ হলে তা জাতির সামনে আমরা তুলে ধরবো’।

এ ব্যাপারে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ক্রসফায়ার, গুম, হত্যা নিয়ে আমাদের ইশতেহারে নিন্দা থাকবে। বিচার বহির্ভূতহত্যাকাণ্ড আমরা সমর্থন করি না। তবে এটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কি প্রতিকার থাকবে এটা আমরা জানা নেই’।

তিনি বলেন, ‘ইশতেহার তৈরি করার জন্য আমাদের একটি কমিটি আছে। তারা এটা নিয়ে কাজ করেছেন। তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন’।

ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার কমিটির সদস্য প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা একটা খসড়া ইশতেহার তৈরি করেছি। এটা ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির হাতে দেয়া হবে। তারা এটা চূড়ান্ত করে জাতির সমানে তুলে ধরবেন’।

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, খসড়া ইশতেহারে বলা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম (এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারান্স) পুরোপুরি বন্ধ হবে। রিমান্ডের নামে পুলিশি হেফাজতে যেকোনো প্রকার শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করা হবে।

আরো বলা হয়েছে, সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। বিপথগামী রাজনৈতিক কর্মীদের হাত থেকেও নাগরিকগণ সুরক্ষিত থাকবে। মামলাজট কমানোর নানা পদক্ষেপের সাথে উচ্চ আদালতের বাৎসরিক ছুটি ছয় সপ্তাহে সীমিত করা হবে।’

তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য থাকা উচিত বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।

মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমরা সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমার দাবি থাকবে, তারা কীভাবে আগামী দিনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখবে ইশতেহারে তার একটা ঘোষণা থাকতে হবে’।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দল নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে মন্তব্য করতে চাই না। সবার কাছেই আমার দাবি থাকবে তারা কীভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন তার ঘোষণা ইশতেহাবে দিবেন’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘গুম হচ্ছে খুনের চেয়েও জঘন্য। আন্তর্জাতিক আইনে বলা আছে, গুম বা খুন পরিকল্পিত হলে এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ। যারা এর বিচার পাচ্ছেন না, তারা আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চাইতে পারেন’।

উল্লেখ্য, জাতীয় ঐক্যফ্যন্টের ৬ সদস্যের একটি কমিটি নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরির কাজ করছে।

কমিটির প্রধান করা হয়েছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে।

বাকিরা হলেন— সাংবাদিক ড. মাহফুজ উল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকী, ডা. জাহেদুর রহমান, শফিক উল্লাহ ও শফিকুল হক স্বপন।