গৃহপালিত বিরোধী দলের বদনাম ঘুচলো না জাপার

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দুই মেয়াদে সংসদের বিরোধী দলের জন্য নির্ধারিত আসনে বসছেন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (জাপা) সংসদ সদস্যরা। তবে বিরোধী দল হিসেবে তারা কতটা ভূমিকা পালন করতে পারছেন তা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে দলটির ভেতরে-বাইরে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত সংসদে একইসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ ও বিরোধী দলে থেকে জাতীয় পার্টি ছিল ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল। আর এবার মন্ত্রিপরিষদের বাইরে থেকে তারা পালন করছে ‘ফরমায়েশি’ বিরোধী দলের ভূমিকা।

জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, এবার মহাজোটের শরিক দল হিসেবে নির্বাচন করেও সরকারের ইচ্ছায় জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসনে বসেছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ অনেক সিদ্ধান্তও নেওয়া হচ্ছে সরকারি দলের ইচ্ছায়। তাদের মতে, এর বড় উদাহরণ হলো- সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত জিএম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যানের পদ ও সংসদে বিরোধী দলের উপনেতার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া। তার জায়গায় আনা হয়েছে সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত রওশন এরশাদকে।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘এক-দুই মাসের কর্মকাণ্ড দিয়ে তো কাউকে মাপা যাবে না। তবে আমরা সংসদে সরকারের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে কথা বলা শুরু করেছি। মাঠে হয়তো সেইভাবে কোনও কর্মসূচি ছিল না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দলে কে সরকারপন্থী আর কে কোন নেতার অনুসারী এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। আমি জাতীয় পার্টির লোক এটাই সত্য।’

দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ বলেন, ‘এবারের সংসদে তো জাতীয় পার্টির বিরোধী দলের আসনে বসার কথা ছিল না। সরকারের ইচ্ছায় সংসদীয় রাজনীতি ব্যালেন্স করার জন্য আমরা বিরোধী দল হয়েছি। এছাড়া বিরোধী নেতা ও পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দীর্ঘদিন অসুস্থ। যার ফলে বিরোধী দল হিসেবে আমরা কোন বিষয়ে কথা বলবো আর কোন বিষয়ে বলবো না সেটা নির্ধারিত নয়। কিন্তু এবার আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি বিরোধী দল হওয়ার।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি দলের চেয়েও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি অনেক বেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সরকারের ভুল-ক্রটি ধরিয়ে দিয়ে সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, সংসদীয় কমিটিগুলোকে সক্রিয় করে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, বিভিন্ন দুযোর্গ ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে কথা বলা বা মূলতবী প্রস্তাব এনে আলোচনা করা। কিন্তু তার কোনও কিছুই করতে পারেনি বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি। বিরোধী দল বা মন্ত্রিপরিষদে তাদের থাকা না থাকা নির্ভর করে সরকারি দলের ইচ্ছার ওপর। ফলে জাতীয় পাটি হচ্ছে ফরমায়েশি বিরোধী দল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জাতীয় পার্টি কোনোভাবেই বিরোধী দল নয়। তারা হচ্ছে গৃহপালিত বিরোধী দল। আর দলটির নেতৃত্বের ওপর আমাদের কোনও আস্থা নেই। কারণ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন ক্ষমতা দখল করলেন, তখন তার নিজের পদের নাম নিয়েছিলেন সিএমএলএ। অর্থাৎ চিফ মার্শাল ল’এডমিনিস্ট্রেটর। তো ’৮২ সাল থেকে তার যে স্বভাব ছিল তা বজায় রেখেছেন। কাজেই এই দলের কোনও ভবিষ্যত দেখছি না। তারা তো বর্তমানে বিরোধী দল নয়, ভবিষ্যতেও হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখছি না।’

নির্বাচন বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিরোধী দলের মূল কাজ হলো- সরকারের সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সংসদীয় কমিটিগুলোকে সক্রিয় করে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। কিন্তু তারা তো তার কিছুই করে নাই। যেমন চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটা পাবলিক হেয়ারিং বা মূলতবী প্রস্তাব এনে সংসদে এটা নিয়ে একদিন আলোচনা করা দরকার ছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টি তো কিছুই করে নাই। আসলে তারা একটা ফরমায়েশি বিরোধী দল।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা তো বিরোধী দল হতে চায় না, তারা সরকারের মন্ত্রিত্ব চায়। তারা বিরোধী দল হিসেবে মনে করে সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে শান্তির সঙ্গে থাকবেন। সরকার থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে খাবেন। এটা কীভাবে বিরোধী দল হয়?’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলটির নেতারা বলছেন, বিরোধী দলের ভ‚মিকা পালন করতে হলে আগে দলকে সুসংগঠিত করতে হবে। সকালে এক সিদ্ধান্ত, বিকালে আরেক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরোধী দলের ভ‚মিকা পালন তো দূরের কথা, দলও ঠিক রাখা যাবে না। দলের অভ্যন্তরে একাধিক গ্রুপ রয়েছে। কেউ এরশাদপন্থী, কেউ রওশনপন্থী, কেউ আবার সুযোগ সন্ধানী। আবার দলের মধ্যে কার কী রোল হবে সেটাও ঠিক নেই। ফলে ক্ষণে ক্ষণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে এরশাদকে।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ বলেন, ‘বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পার্টির চেয়ারম্যান বা সভাপতির একক ক্ষমতা দেওয়া আছে। তার মতামতের ওপর ভিত্তি করে দলের অন্য সবাইকে চলতে হয়, কথা বলতে হয় এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অর্থাৎ দলগুলোর মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলার অভাব থাকে। আমাদের দলের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের মতামতের বাইরে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ফলে দলের ভালমন্দ নির্ভর করে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের ওপর।’

এ ব্যাপারে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এরশাদের অবর্তমানে এই দলের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। কারণ বিভিন্ন দলছুট সুবিধাভোগী লোকদের নিয়ে এই দল তৈরি হয়েছে। যার ফলে সুবিধা পেয়ে সকালে এক সিদ্ধান্ত নেয়, আবার আরেক জনের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে বিকালে আরেক সিদ্ধান্ত নেয়। যার ফলে এই দলের পক্ষ কোনোদিন বিরোধী দল হওয়া সম্ভব নয়।’