গ্যাস ও তেলের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা

বছর ঘুরতে না ঘুরতে আরেক দফা গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। পাশাপাশি কেরোসিন, ডিজেল ও ফার্নেস তেলের দামও বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা চলছে। চলতি বছরে ১০০০ মিলয়ন ঘনফুট এলএনজি (তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করতে ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে। এ টাকা সমন্বয় করতে গ্যাসের দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

আরও জানা গেছে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সোমবার এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সঙ্গে বৈঠক করেছে জ্বালানি বিভাগ। বৈঠক শেষে তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ সবগুলো বিতরণ কোম্পানিকে এলএনজির দাম সমন্বয় করতে কি পরিমাণ দাম বাড়াতে হবে তা লিখিত আকারে বিইআরসির কাছে জানাতে বলা হয়েছে। এর পর পরই বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম সমন্বয় করার প্রস্তাব তৈরির কাজ শুরু করেছে। কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম বাড়ানোসংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরি করে আগামী দু-এক দিনের মধ্যে বিইআরসির কাছে জমা দেবে।

যদিও বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কিছু দিন আগে বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে নতুন করে আর প্রাকৃতিক গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা সরকারের নেই।

গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি সরকার গ্যাসের গড় মূল্য ২২.৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে। বিইআরসি দুই দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিলেও উচ্চ আদালতের রায়ে তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

সরকার গত কয়েক বছরে সাড়ে ৩শ’র বেশি শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগের অনুমোদন দিলেও তা অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি। পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকায় সরকার এসব শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ দিতে পারছে না। এ কারণে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আগামী এপ্রিলে প্রথম দফায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। দ্বিতীয় দফায় অক্টোবর মাসে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। এজন্য সরকারকে অতিরিক্ত ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা বেশি অর্থ গুনতে হবে। এর মধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকা জোগান হবে এনার্জি সিকিউরিটি ফান্ড থেকে। বাকি টাকার জোগান দিতে সরকার আন্তর্জাতিক ইসলামী ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে উচ্চ মূল্যের ঋণ নেয়ার পাশাপাশি গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

ঋণের জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব মাহমুদা বেগমের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দল আইটিএফসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে শিগগির সৌদি আরব সফর করবে। জানা গেছে, আইটিএফসি এলএনজি আমদানির জন্য বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। এ ঋণের জন্য সরকারকে সুদ গুনতে হবে ৩.৮ শতাংশ হারে। বাকি টাকার জোগান দিতে সোমবার গ্যাসের মূল্য সমন্বয়সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি বিইআরসির সঙ্গে বৈঠক করেছে।

বিইআরসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৈঠকে তিতাস, জালালাবাদ, কর্ণফুলি, বাখরাবাদ, পিজিসিএলসহ সব বিতরণ কোম্পানিকে দাম সমন্বয় করে প্রস্তাব পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। কোম্পানিগুলো যদি দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিইআরসিকে প্রস্তাব দেয় তাহলে তারা যাচাই-বাছাই করে গ্যাসের দাম বাড়ানো যাবে কিনা সিদ্ধান্ত দেবেন।

আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার এলএনজি বিক্রি হচ্ছে ১৩.৫২ টাকায়। অপর দিকে স্থানীয়ভাবে দেশে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম রাখা হচ্ছে গড়ে ৭.৩৫ টাকা। এতে ঘাটতি দাঁড়ায় ৬.১৭ টাকা। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে বর্তমানে ২৬৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেক গ্যাস চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে। অথচ এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম পাচ্ছে মাত্র ২.৭০ থেকে সাড়ে ৩ টাকায়। এখানেও সরকার সাড়ে ৩ টাকার বেশি ভর্তুকি দিচ্ছে। এলএনজি এলে এ ভর্তুকি দাঁড়াবে ১০ টাকার বেশি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার বিদ্যুৎ ও সার খাতে যদি ভর্তুকি না দিত তাহলে এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। এ খাতে দেয়া ভর্তুকি দিতে গিয়ে এখন জনগণের পকেট কাটার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। অথচ মাত্র ১৪ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে বাসাবাড়িতে আর ২০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে। দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ৩৭৮১ এমএমসিএফডি। আর সরবরাহ করা হয়েছে ২৭৪৫.৮ এমএমসিএফডি।

বাড়ছে জ্বালানি তেলের দাম : বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) গত সপ্তাহে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে। ওই প্রস্তাবে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৭ টাকা আর প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম ১৩ টাকা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তবে অন্য কোনো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কথা উল্লেখ নেই প্রস্তাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা। বিপিসির প্রস্তাব অনুযায়ী নতুন দাম কার্যকর হলে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৭ টাকা বাড়িয়ে হবে ৭২ টাকা। একই ভাবে প্রতি লিটার কেরোসিনের দামও ৬৫ টাকা থেকে বেড়ে ৭২ টাকা হবে। অপর দিকে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম এখন ৪২ টাকা। নতুন দাম কার্যকর হলে প্রতি লিটার ফার্নেস ওয়েলের দাম পড়বে ৫৫ টাকা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বর্তমানে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ–্যৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৩৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ফার্নেস তেলের দাম বাড়ালে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎও বেশি দামে ক্রয় করতে হবে সরকারকে। এর ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। অপরদিকে ডিজেলের দাম বাড়লে আগামী ব্যুরো মৌসুমে সেচ কাজে বিদ্যুতের খরচ বেড়ে যাবে। এতে কৃষি উৎপাদনের খরচ কৃষকদের নাগালের বাইরে চলে যাবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। তখন পেট্রল-অকটেন লিটার প্রতি ৫ টাকা এবং ডিজেল কেরোসিনের দাম ৭ টাকা করে বাড়ানো হয়েছিল। অপর দিকে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল অকটেন ও পেট্রল প্রতি লিটারে ১০ টাকা এবং ডিজেল ও কেরোসিন প্রতি লিটারে তিন টাকা করে কমানো হয়েছিল।