চার্জশিটের আগে সরকারি কর্মচারী গ্রেফতারে অনুমতি লাগবে

চার্জশিট গ্রহণের আগে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত কোন সরকারি কর্মচারীকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়ার বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

সোমবার রাজধানীর তেজগাঁয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অবশেষে বহুল প্রতীক্ষিত আইনটি অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এই অনুমোদনের কথা জানান।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। চার্জশিট হওয়ার পরে অ্যারেস্ট করার জন্য অনুমতি লাগবে না।’

‘ফৌজদারি মামলার কোনো ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা এক বছরের বেশি মেয়াদে দণ্ডিত হয় তবে রায়ের দিন থেকে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত হবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় এক বছরের কম সময় কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাকে ছোট অফেন্স যেমন- তিরস্কার, বেতন স্থগিতকরণ-অবনমতিকরণ এ রকম ছোট শাস্তি দিতে পারবে।’

দুর্নীতি দমন কমিশন বর্তমানে ফাঁদ পেতে সরকারি কর্মচারীদের ধরছে, এই আইন কার্যকর হলে সেটি বাধাগ্রস্ত হবে কিনা- জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘বাধাগ্রস্ত হবে না, একটু বিলম্বিত হবে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে। অর্থাৎ চার্জশিট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমরা ধরে নেই যে চার্জশিট হলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হয় তিনি দোষী। এর আগে তো কাউকে দোষী না নির্দোষ সেটা বলা যাবে না।’

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এই আইনে সরকারি কর্মচারী সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো আন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনেক বিষয় আছে, যেহেতু আইন বড় হয়ে যায় তাই বিধির জন্য রাখা হয়েছে, বিধি দিয়ে কাভার করা হবে।’

নিয়োগের ভিত্তি মেধা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা

শফিউল আলম বলেন, ‘খসড়া আইনে বলা হয়েছে মেধা, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হবে। মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ ও সন্তোষজনক চাকরি বিবেচনায় নিয়ে পদোন্নতি দেয়া হবে।’

শিক্ষানবিশকাল ও চাকরি স্থায়ীকরণ, প্রেষণ ও লিয়েন, বদলি, পদায়ন ও কর্মস্থল নির্ধারণ বিধি দিয়ে নির্ধারণ করা হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

খসড়া আইনানুযায়ী বর্তমান পদ্ধতিতেই সরকারি কর্মচারীদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হবে জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, ‘বেতন, ভাতা ও সুবিধা সরকারি গেজেট দিয়ে নির্ধারণ করে দিতে পারবে। বিদ্যমান বিধান ও আদেশ অনুযায়ী ছুটি দেয়া হবে। প্রশিক্ষণ, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং নিয়েও আইনে বলা আছে।’

‘কোন কর্মচারীর বিরুদ্ধে সরকারি দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে তাকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ, অবমাননা, মানহানি বা অন্য কোনো মামলা হলে তিনি সরকারি আইন কর্মকর্তার সহায়তায় বা নিজ দায়িত্বে তা পরিচালনা করতে পারবেন। এই মামলার খরচ সরকার বহন করবে। তবে দুর্নীতির অভিযোগে হলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে মামলা হলে সেই মামলা চালানোর অর্থ পাবে না।’

সেবা প্রদানের গাফিলতি হবে অসদাচরণ ও অদক্ষতা

খসড়া আইনানুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের প্রার্থিতা সেবা দিতে হবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘যদি সেবা দিতে না পারে তবে সেবাপ্রার্থীকে তা অবহিত করতে হবে। কোনো কর্মচারী ইচ্ছাকৃত বা অভ্যাসগতভাবে এই ধারার বিধান যদি লঙ্ঘন করে তবে অসদাচরণ ও ক্ষেত্রমতে অদক্ষতা বলে গণ্য হবে।’

‘সেবাপ্রার্থী কোনো ব্যক্তির আবেদন নামঞ্জুর বা প্রত্যাখ্যান হলে বা যুক্তিসংগত সময়ে তা নিষ্পত্তি না করা হলে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারবেন। কর্তৃপক্ষ আবেদন বিবেচনায় নিয়ে আদেশ দিতে পারবে। সেবাপ্রদান নিশ্চিত করতে কর্মচারীদের বিষয়ে সাফল্য, উদ্যোগ, উদ্ভাবনী প্রয়াস বা অবদানের জন্য প্রণোদনা, পুরস্কার, স্বীকৃতি বা সম্মানী প্রদান করবে সরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘নিয়মিত অফিসে উপস্থিতি না হলে বেতন কাটা যাবে, এটা আগে অর্ডিনেন্সে ছিল। আচরণ ও শৃঙ্খলা আপিল বিধিমালা দিয়ে করা হবে। বিভাগীয় ব্যবস্থা বলবৎ আইন অনুযায়ী চলবে।’

‘প্রস্তাবিত আইনানুযায়ী কারো কারণে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হলে দায়ী কর্মচারীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। ক্ষতিপূরণের অর্থ দায়ী কর্মচারীর কাছ থেকে আদায় করতে মামলা করা যাবে।’

শফিউল আলম আরও বলেন, ‘সংক্ষুদ্ধ কর্মচারীদের শাস্তির বিধান রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ হওয়ায় তা আপিলযোগ্য হবে না। রাষ্ট্রপতির কাছে রিভিউ আবেদন করা যাবে। এক বছরের মধ্যে রিভিশন করতে পারবেন।’

অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে চাকরিচ্যুত

তিনি বলেন, ‘আইন অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী বিদেশে কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারবেন না। কোনো কর্মচারী বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে তাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে চাকরি অবসানের আদেশ দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলা করার প্রয়োজন হবে না। আর এই আদেশই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।’

দ্বৈত নাগরিকত্ব যাদের আছে তাদের বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘দ্বৈত নাগরিকত্ব নিতে সরকারের অনুমোদন নিতে হয়।’

সরকারি কর্মচারী চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর হলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে ৩০ দিনের নোটিশ দিয়ে অবসরে যেতে পারবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার জনস্বার্থে ২৫ বছর চাকরির পর যে কাউকে কারণ না দেখিয়েই অবসরে পাঠাতে পারবে। চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে চাইলে যে কোনো সময় করা যাবে।’

অবসরের পর বিদেশ যাত্রার অনুমতি লাগবে না

‘চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর কোনো ব্যক্তি বিদেশে চাকরি গ্রহণ, ব্যবসা, বিদেশযাত্রা করলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে না। এতদিন অবসরের পরেও এসব করতে হলে অনুমোদন নিতে হত।’

কেন আইনটি করা হচ্ছে জানতে চাইলে শফিউল আলম বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী আইন পৃথিবীর সব দেশেই আছে জানিয়ে শফিউল বলেন, আমাদের কোনো আইন ছিল না, তাই নতুনভাবে এই আইনটি করা হচ্ছে। এই আইন প্রণয়নে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও আছে। এই আইন কার্যকর হলে গুণগত পরিবর্তন হবে বলেও আশা করছি।’

সরকারি চাকরি আইন কার্যকর হলে এ সংক্রান্ত আগের ছয়টি আইন বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই এ আইন প্রণয়ন করেনি। বিধি, নীতিমালা ও প্রয়োজনমতো নির্দেশনাপত্র জারি করে সরকারি কর্মচারীদের পরিচালনা করছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন গত মহাজোট সরকারের সময় আইনটি করার জন্য কয়েক দফা খসড়া প্রণয়ন করা হলেও খসড়ার বিভিন্ন বিধান নিয়ে বিতর্ক ওঠায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি।

আওয়ামী লীগ সরকার ফের ক্ষমতায় আসলে ২০১৫ বছরের ১৩ জুলাই ‘সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৫’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে ২০১৬ সালের ২৪ নভেম্বর আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হলে তা অনুমোদন পায়নি।

তখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছিলেন, ‘এটা (সরকারি কর্মচারি আইন) ছিল ১৬ ধারার ছোট আইন। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের পর এটা ৭১টি ধারার অনেক বড় আইন হয়ে গেছে। এজন্য মন্ত্রিসভা বলেছে এটা একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। কারণ অনেক বড় পরিবর্তন হয়ে গেছে।’ এরপর ফের ঝুলে যায় আইনটি।

পরে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় অনুমোদনের জন্য ‘সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়া উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবিত আইনটির বিভিন্ন ধারা আরও চুলচেরা বিশ্লেষণের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইনকে প্রধান করে ৮ সদস্যের একটি উপ-কমিটি গঠন করে সরকার। ওই কমিটি ৫ দফা বৈঠক করে ২৯টি প্রস্তাবসহ প্রতিবেদন জমা দেয়। গত এপ্রিলে সচিব কমিটির বৈঠকে ওই প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়।